বাজেট বিনিয়োগবান্ধব নয়, দাবি ব্যবসায়ীদের

২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বিনিয়োগবান্ধব হয়নি বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, শিল্প প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ নেই।

ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, উচ্চ উৎপাদন ব্যয়, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ও সুদের হার বৃদ্ধির কারণে সংকটের মধ্যে আছে দেশের শিল্পখাত। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব না দিয়ে বাজেটে রাজস্ব আয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

তারা বলেন, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক—বিশেষ করে রড ও সিমেন্টের মতো নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামাল এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের কর বৃদ্ধি বিপরীতমুখী উদ্যোগ।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, '২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বিনিয়োগবান্ধব নয় এবং এটি শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে।'

তিনি বলেন, 'করপোরেট কর হার বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রণোদনা বাতিল ও ব্যবসা পরিচালনার খরচ বৃদ্ধিতে এই বাজেট বেসরকারি খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রভাবিত এই বাজেটে দেশীয় শিল্পগুলোর টিকে থাকার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।'

তিনি নির্মাণসামগ্রীর ওপর কর বৃদ্ধি, টার্নওভার কর বৃদ্ধির মতো প্রস্তাব এবং নতুন খাতগুলোর জন্য প্রণোদনা প্রত্যাহারের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন।

তিনি মন্তব্য করেন, তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের ওপর দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ কর বৃদ্ধি একটি 'শাস্তিমূলক ব্যবস্থা', যা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করবে। ইতোমধ্যে উচ্চ জ্বালানি খরচ, সুদের হার ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে শিল্পখাত সংকটের মুখে আছে।

তিনি মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যে সবকিছুর দাম বেড়েছে।'

'গ্যাস, বিদ্যুৎ, আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগে কমে যাচ্ছে,' বলেন তিনি।

তিনি মনে করেন, 'বাজেটে রাজস্ব আয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, ব্যবসায়িক পরিবেশ পুনরুদ্ধারকে নয়। ফলে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়তে পারে ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমতে পারে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ প্রস্তাবিত বাজেটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা দেখলেও বিনিয়োগ পরিবেশ, শিল্প প্রতিযোগিতা এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা, ন্যূনতম কর ব্যবস্থা সংশোধন, করযোগ্য খরচ বাড়ানো এবং স্বয়ংক্রিয় রিটার্ন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবসা সহজ করার জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় বাজেটের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'কর ব্যবস্থার অটোমেশন ও ডিজিটাল কমপ্লায়েন্সে প্রশংসনীয় অগ্রগতি থাকলেও, টার্নওভার ট্যাক্স বৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছোট ব্যবসাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং বেসরকারি খাতে তারল্য কমতে পারে।'

তিনি আরও সতর্ক করেন, আমদানি বিকল্প শিল্প ও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ওপর উচ্চ কর দেশীয় উৎপাদন নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে।

'এই বাজেটে স্থিতিশীলতা আনার ইচ্ছা আছে, তবে বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের জন্য কার্যকর কৌশল না থাকলে ব্যবসাগুলো চাপের মধ্যের পড়বে,' যোগ করেন তিনি।

নিউএজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, আমদানিকারকদের জন্য অগ্রিম কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ করার সিদ্ধান্তটি উদ্বেগজনক, যা অনেক এসএমই উদ্যোক্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে—কারণ তারা কাঁচামাল এসব আমদানিকারকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।

এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণের বিপরীতে বাজেট প্রস্তাবে প্লাস্টিক শিল্পে ভ্যাট সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল—যেমন তুলার সুতা ও ম্যান-মেইড ফাইবারের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) মহাসচিব মো. জাকির হোসেন সরকারের এপিআইয়ের (অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস) ওপর ভ্যাট অব্যাহতি ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি একটি সময়োপযোগী ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এখনো এপিআই উৎপাদনে সক্ষমতা গড়ছে। এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতির পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানি ও পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়নের মুখে এই বাড়তি সময় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।'

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালি চৌধুরী প্রস্তাবিত বাজেটের নগদহীন লেনদেন ও শেয়ার ফ্লোটের প্রস্তাবকে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানালেও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সতর্ক করেন।

তিনি বলেন, '১০ শতাংশ পাবলিক ফ্লোট ও বাধ্যতামূলক ডিজিটাল বিক্রয় নিশ্চিত করা সুশাসনের জন্য ভালো পদক্ষেপ, তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল অবকাঠামো এখনো দুর্বল।'

এই নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর হার ২২ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এটিকে তিনি 'শাস্তিমূলক ব্যবস্থা' হিসেবে অভিহিত করেন।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামালও বাজেটকে দেশীয় উৎপাদন শিল্পের জন্য 'চ্যালেঞ্জিং' বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, 'যেভাবে ভ্যাট ও কর হার বাড়ানো হয়েছে, তাতে উৎপাদন খরচ বাড়াবে এবং দেশীয় উৎপাদন নিরুৎসাহিত করতে পারে।'

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, সরকার যেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, সেখানে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার বাস্তবায়ন।

তিনি পরামর্শ দেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিকভাবে এগোতে হলে সংকট ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব স্থিতি এবং প্রধান নীতিগত সংস্কারগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

'Rab destroyed secret detention centres post August 5'

Finds Commission of Inquiry on Enforced Disappearances

43m ago