ব্যবসায় বাড়ছে খরচ, কমছে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা

দীর্ঘদিন ধরে কম ও প্রতিযোগিতামূলক শ্রম বাজারের দেশ হিসেবে অন্যদের কাছে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছিল পরবর্তী 'এশিয়ান টাইগার' হিসাবে। এখন এ দেশে মূল খাতগুলোয় ব্যবসা করার খরচ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় কমছে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা।
একসময় যে সস্তা শ্রম দেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হতো এখন অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নীতিগত অনিশ্চয়তা ও ব্যবসায় ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে সেই সুবিধা কমে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ মূল্যায়ন ও আঞ্চলিক বাণিজ্য জরিপে দেখা গেছে—ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমমূল্য তুলনামূলকভাবে কম হলেও লজিস্টিক, জ্বালানি, অর্থায়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিসহ মোট খরচ কাঠামো ক্রমেই নেতিবাচক হয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক প্রায় ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়ায় বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশের রপ্তানি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ইতিবাচক নয়।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তৈরি করা লজিস্টিক সেক্টরের সমন্বিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—উৎপাদন খরচের ১৫-২০ শতাংশ আসে লজিস্টিকস থেকে। ভিয়েতনামে তা নয় থেকে ১১ শতাংশ।
এর প্রধান কারণ দুর্বল সড়ক অবকাঠামো, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যজট ও পুরোনো লজিস্টিক ব্যবস্থা।
ভিয়েতনাম গভীর সমুদ্র বন্দর ও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করায় পণ্য সরবরাহে সময় কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ খরচ কমেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়েছে।
জ্বালানি আরেকটি বড় বাধা।
আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও ফার্নেস অয়েল ব্যয়বহুল হওয়ায় এসবের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসাকে অস্থিতিশীল করেছে।
তুলনামূলকভাবে, ভিয়েতনাম ও ভারত সফলভাবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়েছে। এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। উৎপাদন অনিশ্চয়তা কমেছে।
ছোট অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও কম্বোডিয়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাশ্রয়ী দামে জলবিদ্যুৎ আমদানি করায় উপকৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
সম্প্রতি স্মার্ট সুদ হার গ্রহণ করায় ব্যবসায়িক ঋণের সুদ হার ১৩ শতাংশের বেশি।
ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠানগুলো সাত থেকে নয় শতাংশ সুদে ঋণ পায়। ভারত সম্প্রতি আর্থিক নীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের সুদ হার আট থেকে ১০ শতাংশ করেছে।
বাংলাদেশ নীতিগত অসঙ্গতিও মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শুল্ক কাঠামোয় ঘন ঘন পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেরি ও মূল ব্যবসায়িক নীতিতে পূর্বাভাসের অভাব দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।
ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ মেনে চলছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ২০২১ সালে পরিচালিত 'ভিয়েতনামের চমৎকার রপ্তানি পারফরম্যান্স: বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা' শীর্ষক তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে—ভিয়েতনাম এখন বার্ষিক সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) হিসেবে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে।
বাংলাদেশ তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশ কম্বোডিয়ার মাথাপিছু বিদেশি বিনিয়োগও বাংলাদেশের তুলনায় বেশি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ কাঠামোগত সমস্যার গভীরে আটকে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বেশ কয়েকটি মৌলিক জায়গায় আটকে আছি। লজিস্টিকস, ব্যবসায় অর্থায়ন ও মূলধনের উচ্চ সুদ খরচের সীমাবদ্ধতা আছে। একমাত্র টেকসই সুবিধা হলো কম শ্রম খরচ। এটিও হুমকির মুখে।'
তিনি মনে করেন—অবকাঠামো, বন্দর ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় অর্থায়ন ও দক্ষতা উন্নয়নে দুর্বলতাগুলো দূর করতে না পারলে তৈরি পোশাকের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য রপ্তানির উচ্চাকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যাবে।
তার মতে, রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে দেশে জরুরি ভিত্তিতে নীতি সংস্কার, শক্তিশালী অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ত্বরান্বিত করতে সহায়ক নীতিমালা দরকার।
'শুল্ক কমানো ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য দ্বিপক্ষীয়, বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় সক্রিয় অংশ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর সেসব সংকট আসবে সেগুলো মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তার মতে, বিষয়টি এখন আর পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ নেই। প্রচুর খরচ ও কাঠামোগত অদক্ষতার কারণে পুরো ব্যবসা চাপে পড়েছে।
'ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক সংরক্ষণবাদ ও অটোমেশন বিশ্বব্যাপী ভ্যালু চেইনকে নতুন আকার দিচ্ছে। শক্তিশালী দেশগুলো এসবের সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।'
বাণিজ্য সহজ করতে, লজিস্টিক আধুনিক করতে, অবকাঠামো শক্তিশালী করতে ও মানবসম্পদ গড়ে তুলতে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
'সময়োপযোগী ও সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ও রপ্তানির কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হতে থাকবে।'
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ রপ্তানিকারক আসিফ ইব্রাহিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বেড়ে যাওয়ার ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।'
'এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানির জন্য বোঝা হবে। বিশেষ করে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা করে এমন কয়েকটি দেশকে বাংলাদেশের তুলনায় কম শুল্ক দিয়ে হবে।'
তিনি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে জরুরি ভিত্তিতে এই সংকট মোকাবিলা করতে নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষা ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার মাধ্যমে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও পরীক্ষায় পড়বে।
উল্লেখযোগ্য সংস্কার না হলে ব্যবসার ক্রমবর্ধমান খরচ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে থাকবে।
Comments