দারিদ্র্য কমাতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভূমিকা কম

ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিংয়ের (ভিজিএফ) বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ভাতার মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রকৃত দরিদ্রদের খুব একটা উপকারে আসেনি। যদিও সরকার মাঝারি ও চরম দারিদ্র্য কমাতে এই প্রকল্পগুলোর প্রভাব নিয়ে গর্ব করে।
গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া টাস্কফোর্স প্রতিবেদনে বলা হয়, লক্ষ্য নির্ধারণে অস্পষ্টতা, ভুল মানুষকে সুবিধা দেওয়া কিংবা যাদের প্রয়োজন নেই এমন মানুষকে সুবিধা দেওয়ার মতো ক্রমাগত ত্রুটির কারণে এসব কর্মসূচির প্রভাব কম ছিল।
২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ব্যবহার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট ও মাঝারি দারিদ্র্য শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ পয়েন্ট কমাতে পেরেছে।
এতে আরও বলা হয়, বেশিরভাগ প্রকল্প দারিদ্র্য মোকাবিলার মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারেনি। শক্তিশালী আয় সহায়তা না থাকায় মাঝারি-চরম দারিদ্র্য মোকাবিলায় ফাঁক থেকে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে—২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ৩১ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক সাত শতাংশে নেমে এসেছে। বার্ষিক গড়ের তুলনায় তা এক দশমিক শূন্য সাত শতাংশ কম।
একই সময়ে চরম দারিদ্র্য ১৭ দশমিক ছয় শতাংশ থেকে কমে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে আরও বলা হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ২০১০ সালে চার কোটি ৫৪ লাখ থেকে কমে ২০২২ সালে তিন কোটি নয় লাখ হয়েছে। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৫৩ লাখ থেকে কমে হয়েছে ৯৩ লাখ।
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর গঠিত টাস্কফোর্স বলছে, অন্তর্ভুক্তির ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হলে ও দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য আবার বরাদ্দ দেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও বদলাতে পারে।
প্রতিবেদন অনুসারে, দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পে সমন্বয় করা হলে চরম দারিদ্র্য এক দশমিক তিন শতাংশ পয়েন্ট ও মধ্যম দারিদ্র্য আড়াই শতাংশ পয়েন্টে কমতে পারে।
২০২২ এইচআইইএসের তথ্য দেখা যায়, ৫৩ দশমিক নয় শতাংশ দরিদ্র ও দুর্বল পরিবারগুলো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে বাদ পড়েছে।
সংশোধন প্রচেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়েছে
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ত্রুটিগুলো কাটাতে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল (এনএসএসএস) ২০১৫ সালে গৃহীত হয়েছিল। এতে জীবনচক্র পদ্ধতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলা হয়।
জীবনচক্র পদ্ধতি বলতে বোঝায় দারিদ্র্য বিমোচন নীতি ও কর্মসূচি এমনভাবে সাজানো যেখানে শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের প্রয়োজনগুলো তুলে ধরা হয়।
কাঠামোগত অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা ও সীমিতহারে অন্তর্ভুক্তিসহ সমস্যাগুলো এর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং পুরো ব্যবস্থার কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে।
এই ত্রুটিগুলো দারিদ্র্য দূর করতে বাধা দেওয়ায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রভাব কমেছে।
এনএসএসএস লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম বলে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
২০২৬ সালের জুনে এনএসএসএস'র মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকায় ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনো বাস্তবায়িত না হওয়ায় এর সম্ভাবনাটুকুও অধরা থেকে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এই ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবে দারিদ্র্য মোকাবিলায় সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই সাজানো হয়েছে। সীমিত সম্পদ ও স্বল্প সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্য মোকাবিলায় এর ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
সামাজিক সুরক্ষায় অতিরঞ্জন
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দে অনেক সম্পর্কহীন ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প থাকায় শুধু যে এর বাজেট বেড়েছে তাই নয়, বরং দারিদ্র্য মোকাবিলায় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকেও অস্পষ্ট করে তুলেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে—সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, ভর্তুকি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ ও অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির মতো প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করায় সামাজিক সুরক্ষা ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত হয়েছে।
বাজেট বরাদ্দের ভিত্তিতে ছয় বৃহত্তম প্রকল্পের মধ্যে কেবল বার্ধক্য ভাতা প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খরচ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আড়াই শতাংশ ও জাতীয় বাজেটের ১৭ শতাংশ।
পেনশন ও ভর্তুকি কর্মসূচিগুলো যখন বাদ দেওয়া হয়, তখন বরাদ্দটি জিডিপির মাত্র এক দশমিক দুই শতাংশ ও বাজেটের সাত শতাংশে নেমে আসে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত বিশ্ব সামাজিক সুরক্ষা প্রতিবেদন ২০২৪-২৬-এ ধারণা করা হয়েছে যে বাংলাদেশ সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক নয় শতাংশ খরচ করে। এই সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড় তিন দশমিক আট শতাংশের তুলনায় কম।
প্রাক্কলন থেকে জানা যায়, বার্ধক্য ভাতা (ওএএ) ও বিধবা ভাতার (ডব্লিউএ) মতো মূল কর্মসূচিগুলো থেকে মাসিক সুবিধাগুলো মাথাপিছু জাতীয় দারিদ্র্যসীমার আয়ের মাত্র ১৪ শতাংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা ২২ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেশি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষায় সুবিধা কম। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে খুব কমই সমন্বয় করা হয়। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর প্রকৃত মূল্য ক্রমাগত কমে যায়।
সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে এই Safety net schemes fall short in the fight against poverty লিংকে ক্লিক করুন
Comments