ব্যবসার পরিবেশ ভালো হলেও রাজস্ব আদায় কম
গত জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার পরও নভেম্বরে দেশে রাজস্ব আদায় কমেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাথমিক তথ্য বলছে, নভেম্বরে রাজস্ব আদায় হয় ২৫ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় আট দশমিক ৯৫ শতাংশ কম।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে সার্বিক রাজস্ব আদায় দুই দশমিক ৬২ শতাংশ কমে এক লাখ ৩০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা হয়েছে।
এ ছাড়াও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এক লাখ ৬৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কর আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
গত আগস্টের গোড়ায় ইন্টারনেট বন্ধ, এরপর আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে রাজস্ব আদায়ও কমে।
গত সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে শুরু করলেও রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম ছিল।
রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বিষয়ে রাজস্ব বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আমদানি কমে যাওয়া, কয়েকটি খাতে ভর্তুকি বাড়ানো ও ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপসহ চলমান অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক এমএ রাজ্জাক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার সম্পর্ক আছে।'
আমদানি কম, কর ছাড় ও মূল্যস্ফীতির চাপও সামগ্রিক ঘাটতিতে অবদান রেখেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অনিশ্চয়তা ও তথ্যের অভাবের কারণে বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক সাত শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে চার শতাংশ করেছে।
তার মতে, 'এ বছর দেশের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের তুলনায় কম হতে পারে।'
গত তিন-চার বছর ধরে দেশের আমদানি স্থবির হয়ে আছে। মোট আমদানি ২০২১ সালের ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৭০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
'তাই এনবিআর শুধু আমদানি থেকে পর্যাপ্ত শুল্ক পাবে না।'
কয়েকটি নিত্যপণ্যে উচ্চ ভর্তুকি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এটি রাজস্ব আদায় কম হওয়ার আরেক কারণ হতে পারে।'
'তারপরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমদানিকে রাজস্ব আদায়ের মূল খাত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না।'
রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে আয় শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ কমে ৪১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা হয়েছে।
এ দিকে, আয়কর আদায় দশমিক ৯৪ শতাংশ কমে ৪০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা ও রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) পাঁচ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমে ৪৮ হাজার ৮২ কোটি টাকা হয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, 'মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি কম হয়েছে। ভ্যাট থেকে রাজস্ব আয় কমছে।'
এই পরিস্থিতিতে কম রাজস্ব আদায়ের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও মন্দা এড়াতে উন্নয়ন খরচ কমাতে হতে পারে। 'উন্নয়ন খরচ কম থাকায় রাজস্ব কমেছে,' বলে মনে করেন তিনি।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণ স্বীকার করে বলেন, 'বর্তমানে কম সরকারি খরচ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে রাজস্ব আদায়ে বাধার মুখে পড়ছি।'
এ দিকে, অন্তর্বর্তী সরকার তার পূর্বসূরীর বেঁধে দেওয়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমায়নি।
গত সেপ্টেম্বরে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে।
তিনি আরও বলেছিলেন, 'বিদ্যমান লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব। এ বছর তা অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
Comments