অস্ত্র তৈরি থেকে শুরু, দুই চাকায় রয়্যাল এনফিল্ডের বিশ্বজয়

জনপ্রিয় মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড রয়্যাল এনফিল্ড যাত্রা শুরু করেছিল ২০ শতকের একদম শুরুতে যুক্তরাজ্যে। তখন এর নাম ছিল এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি। ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে এসে এর মালিকানা চলে যায় ভারতের আইসার গ্রুপের কাছে। তবে রয়্যাল এনফিল্ড এই মালিকানা বদলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় ব্র্যান্ড হিসেবেই সবার কাছে সুপরিচিত। কিন্তু এই পরিচিতির কারণ কী? ব্র্যান্ডটি এত জনপ্রিয় কেন?

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই মোটরবাইক ব্র্যান্ডের ইতিহাস একশো বছরেরও বেশি পুরোনো। এর জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ইঞ্জিন, স্থায়িত্ব, আর মনোমুগ্ধকর ডিজাইন। রয়্যাল এনফিল্ড যাত্রা শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যে, আর ধীরে ধীরে এটি ভারতসহ সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছে।

১৮৯৬ সালে রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রা শুরু হয়, যখন এডি মিডলসেক্সের এনফিল্ড শহরে অবস্থিত রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরির জন্য যন্ত্রপাতি তৈরির কন্ট্রাক্ট পায়। এখান থেকেই 'রয়্যাল এনফিল্ড' নামের উৎপত্তি। একই বছর কোম্পানি 'নিউ এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড' নামে একটি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৯৭ সালে সাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু করে। যখন মোটরচালিত সাইকেল ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন এনফিল্ড কোম্পানি নিজস্ব মোটরসাইকেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ দুই বছরের প্রচেষ্টার পর, ১৯০১ সালে তারা তাদের প্রথম মোটরবাইক বাজারে আনে, যা ছিল ২৩৯ সিসির এবং ১১.২ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে রয়্যাল এনফিল্ডের সাফল্যের প্রকৃত মাইলফলক আসে ১৯০৯ সালে, যখন তারা ভি-টুইন ২৯৭ সিসি ইঞ্জিনের একটি শক্তিশালী এবং ব্যতিক্রমী কাঠামোর মোটরসাইকেল তৈরি করে, যা তাদের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ১৮৯৮ প্রথম মোটরচালিত যান তৈরি করলেও রয়্যাল এনফিল্ডের মোটরসাইকেলের যাত্রা শুরু হয় ১৯০১ সালে। নতুন শতাব্দীতে এক নতুন চমক নিয়ে আসে রয়্যাল এনফিল্ড। উদ্যোক্তা বব ওয়াকার স্মিথ আরেক ফরাসি উদ্যোক্তা জুলেস গোটিয়েটকে নিয়ে প্রথম মোটরসাইকেলটি তৈরি করেন।

রয়্যাল এনফিল্ড বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী। বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়্যাল এনফিল্ডের মোটরসাইকেলের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই তারা ২-স্ট্রোক মোটরসাইকেল তৈরি করা শুরু করে এবং যুদ্ধের প্রয়োজন মেটাতে বড় আকারের ৭৭০ সিসি ও ৬ এইচপি ভি-টুইন মোটরসাইকেল তৈরি করে। যুক্তরাজ্যসহ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য এই বাইকগুলো সরবরাহ করা হয়। শক্তিশালী কাঠামো এবং দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতার কারণে সেনাবাহিনীর কাছে এই মোটরসাইকেল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯২৪ সালে রয়্যাল এনফিল্ড নতুন আটটি মডেলের মোটরসাইকেল বাজারে আনে, যার মধ্যে একটি স্পোর্টস মডেলও ছিল। ১৯২৮ সালে তারা বাইকের ডিজাইনে পরিবর্তন আনে, ফ্ল্যাট ট্যাংকের বদলে স্যাডল ট্যাংক যোগ করে এবং সামনের অংশে নতুন নকশা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার রয়্যাল এনফিল্ডের সঙ্গে চুক্তি করে, এবং তারা মিলিটারি গ্রেড ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি, এবং ৫৭০ সিসি মোটরসাইকেল তৈরি শুরু করে। এর মধ্যে বিখ্যাত ছিল রয়্যাল এনফিল্ড ডব্লিউডি/আরই, যা প্লেন থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে ফেলার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল। যুদ্ধের সময় বোমা হামলা থেকে বাঁচতে ওয়েস্টউডে একটি ভূগর্ভস্থ কারখানাও নির্মাণ করা হয়।

শক্ত কাঠামো এবং যান্ত্রিক বিশ্বস্ততার জন্য বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল এই মোটরবাইকগুলো।

এবার চলুন জেনে নেই ভারতে রয়্যাল এনফিল্ডের প্রবেশ কীভাবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর ভারত সরকার একটি শক্তিশালী মোটরসাইকেল খুঁজছিল, যা সীমান্তে টহল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে। ১৯৪৯ সালে রয়্যাল এনফিল্ডের ৩৫০ সিসির বুলেট প্রথমবারের মতো ভারতের বাজারে আসে। রয়্যাল এনফিল্ডের বুলেট ৩৫০ ঠিক সেই চাহিদা পূরণ করেছিল। এর ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৮০০ ইউনিট বুলেট ৩৫০ অর্ডার দেয়। এতো বড় চালান নিয়ে চিন্তায় পড়ে রয়্যাল এনফিল্ড। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল এনফিল্ড এবং ভারতীয় কোম্পানি মাদ্রাজ মোটরস যৌথভাবে চেন্নাইয়ে একটি কারখানা স্থাপন করে। প্রথমদিকে সেখানে বাইকগুলো শুধু অ্যাসেম্বল করা হতো, কিন্তু ১৯৬২ সালের পর থেকে সম্পূর্ণ বাইক ভারতে তৈরি হতে শুরু করে। এইভাবে রয়্যাল এনফিল্ড ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে।

রয়্যাল এনফিল্ডের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার রহস্য কী? প্রথমত এর শক্তিশালী ইঞ্জিন। রয়্যাল এনফিল্ডের বাইকগুলোতে সাধারণত উচ্চ সিসির ইঞ্জিন থাকে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে দীর্ঘ ভ্রমণে এটি বাইকারদের পছন্দের বাইক হয়ে উঠেছে।দ্বিতীয়ত এর স্থায়িত্ব ও টেকসই ডিজাইন। রয়্যাল এনফিল্ডের বাইকগুলো স্টিলের শক্ত কাঠামো দিয়ে তৈরি, যা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। এর যান্ত্রিক নির্ভরযোগ্যতাও বাইকারদের কাছে এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তৃতীয়ত সম্পুর্ন ভীন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লুক, রয়্যাল এনফিল্ডের বাইকগুলোর ডিজাইন সাধারণ বাইকের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এগুলোর ক্লাসিক লুক এবং স্টাইলিশ ডিজাইন বাইকারদের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করেছে। চতুর্থত এর ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা। বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রয়্যাল এনফিল্ডের একটি ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ড ইমেজ রয়েছে। এই ইতিহাসই অনেককে ব্র্যান্ডটির প্রতি আস্থাশীল করে তোলে।

রয়্যাল এনফিল্ড দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই এর আলাদা একটি ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম পুরনো মোটরবাইক ব্র্যান্ড, যা এমনকি বিশ্বখ্যাত হার্লে ডেভিডসন থেকেও পুরনো। ক্ল্যাসিক ধরনের পুরনো ডিজাইন, আলাদা স্টাইল, নজরকাড়া লুক সব মিলিয়েই রয়্যাল এনফিল্ড হয়ে উঠেছে কাল্ট ক্ল্যাসিক এক মোটরবাইক ব্র্যান্ড। রয়্যাল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তার আরও একটি বড় কারণ তাদের প্রতিটি বাইকেই নানা ধরনের কাস্টমাইজেশন বা মড করা সম্ভব। অর্থাৎ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বাইকের পুরো চেহারাই নিজের মতো করে পাল্টে ফেলা সম্ভব। রয়্যাল এনফিল্ড কাস্টমাইজেশনের ব্যাপারে চালকদের উৎসাহিত করে। বিভিন্ন সিনেমায় রয়্যাল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের ব্যবহার এর জনপ্রিয়তাকে আরও অনেক বাড়িয়েছে।

মার্কিন অভিনেতা ব্রাড পিটের অস্কারজয়ী সিনেমা 'দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেনঞ্জামিন বাটন' দেখে থাকবেন। সেখানে তরুণ ব্রাড পিট যে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, সেটি ছিল রয়েল এনফিল্ড ব্রান্ডের। সিনেমায় ভারতের বারানসির রাস্তায় এই মোটরসাইকেলে চালিয়ে ঘুরেছেন ব্রাড পিট। ভারতীয় সিনেমায় বেশিরভাগ আর্মি বা পুলিশ অফিসারকেই দেখবেন রয়্যাল এনফিল্ড চালাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শুধু সিনেমায় নয় বাস্তব জীবনেও অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীর রয়েছে রয়্যাল এনফিল্ড বাইক। এর ঐতিহাসিক ভ্যালু থাকায় – এটি শুধু একটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হিসেবে আর নেই এটি পরিণত হয়েছে কালেক্টেবল আইটেমে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় বহু গ্রুপ এর সন্ধান পাওয়া যায় যারা রয়্যাল এনফিল্ড এর ক্লাসিক মডেলগুলো রিস্টোরেশন করেন এবং নিজেদের সংগ্রহে রাখেন।

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

12h ago