১৫ বছরে স্বপ্নের লোকসান ১৬০০ কোটি টাকা

স্বপ্নের লোকসান ১৬০০ কোটি টাকা

বাংলাদেশের শীর্ষ রিটেইল চেইন ব্র্যান্ড স্বপ্ন পরিচালন মুনাফা করতে পারলেও, গত ১৫ বছরে কোম্পানিটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকায়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে নেওয়া কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ১১৮ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৪২৫ কোটি টাকা।

গত বছরের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বপ্নের আন্তঃকোম্পানি ঋণ ছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।

স্বপ্ন ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শহুরে মানুষের কাছে খুবই পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে রাজধানীতে। আবার যারা একটি জায়গা থেকে সব ধরনের পণ্য কিনতে চান, তাদের কাছেও স্বপ্ন খুব পছন্দের একটি নাম। বর্তমানে ৪৪০টির বেশি আউটলেটের মাধ্যমে স্বপ্ন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

২০১৬ সালে কান্টার মিলওয়ার্ড ব্রাউন ও বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম যৌথভাবে স্বপ্নকে বাংলাদেশের সেরা রিটেইল ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

স্বপ্নের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই লজিস্টিকসের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, 'স্বপ্ন পরিচালন মুনাফা করলেও, ঋণের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ায় নিট লোকসানে ভুগছে।'

আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদরে ঋণ বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১২৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে স্বপ্নের লোকসান হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৩৫ কোটি টাকা।

সাব্বির হাসান নাসির বলেন, 'স্বপ্ন ঋণের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গুনছে, তাই প্রতি বছর ঋণের পেছনে ব্যয়ও বাড়ছে।'

শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটির সঙ্গে একটি কোম্পানির মোট দায় তুলনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের স্বপ্নের ঋণ তার ইক্যুইটির তুলনায় অনেক বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় রিটেইল চেইন সেভেন-ইলেভেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সিপি অল এর ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ২ দশমিক ৩, যেখানে স্বপ্নের ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ৪৪।

বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতের বিগ বাজারের ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ছিল ৯ দশমিক ৩৪ এবং বিশ্বের বৃহত্তম খুচরা চেইন ওয়ালমার্টের ছিল শূন্য দশমিক ৪৯। গ্লোবাল চেইন শপগুলোর বেশিরভাগের এই অনুপাত এক এরও কম।

ইনভেস্টোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত শিল্প ভেদে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু এটি দুই এর বেশি হওয়া উচিত নয়।

সাব্বির হাসান নাসির বলছেন, 'স্বপ্নের আন্তঃকোম্পানি ঋণ ইক্যুইটিতে রূপান্তরিত হলে তখন আর কোম্পানিটির সুদ ব্যয় বাড়বে না এবং কোম্পানিটি মুনাফা করা শুরু করতে পারবে।'

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি একুশ ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আহসান মারুফ বলেন, 'এই লোকসানের মূলে আছে বিপুল ঋণ, কারণ বেশি ঋণের জন্য কোম্পানিটির ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় বেড়েছে।'

এসিআই লজিস্টিকস ১৯৭৬ সাল থেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এসিআই লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এসিআই লজিস্টিকসসহ কয়েকটি সাবসিডিয়ারির ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে গ্রুপটি সাম্প্রতিক কয়েক প্রান্তিকে লোকসান করছে।

কাজী আহসান মারুফ বলেন, 'যেহেতু স্বপ্নের ব্যবসা উচ্চ ভলিউম নির্ভর কিন্তু মুনাফার মার্জিন (হার) কম। তাই ঋণের পরিমাণ উচ্চ পর্যায়ে থাকলে এ ধরণের ব্যবসা লাভজনকভাবে চলতে পারে না।'

আর্থিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যবসার আকারের তুলনায় ইক্যুইটি (পরিশোধিত মূলধন) ছোট হওয়ায় বোর্ড তার পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে। স্বপ্নের ইক্যুইটি ৩৬ কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটির দায় তার মোট সম্পদের পরিমাণের চেয়ে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে কোম্পানিটির দায় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা এবং সম্পদের পরিমাণ ৬৭৫ কোটি টাকা।

তবে সাব্বির হাসান নাসির বলছেন, 'পুঞ্জীভূত লোকসানের চেয়ে এই কোম্পানির বাজার মূল্য অনেক বেশি।'

'ইতোমধ্যে একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি মূল্য প্রস্তাব করেছেন। আমরা মনে করি এটা আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি হবে,' যোগ করেন তিনি।

যদি পরিচালনা পর্ষদ ইক্যুইটি বিনিয়োগ বাড়ায়, এটি মুনাফায় ফিরতে পারে। কারণ এটি ইতোমধ্যে অপারেটিং মুনাফা করতে শুরু করেছে।

যদি স্বপ্ন তার আন্তঃঋণকে ইক্যুইটিতে রূপান্তর করে, তাহলেও এটি মুনাফায় ফিরতে পারে।

আরেকটি বিকল্প হতে পারে, যদি কোম্পানি আরও আউটলেট চালু করে, তাহলে ক্রমবর্ধমান অপারেটিং মুনাফা ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় কমাতে পারবে।

সাব্বির হাসান নাসির বলেন, 'এ লক্ষ্যে আমরা প্রতি বছর ৪০০টি আউটলেট খোলার লক্ষ্যমাত্র নিয়েছি। বর্তমানে প্রতি মাসে ২৫টি আউটলেট খোলা হচ্ছে।'

'আমরা যদি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারি, তাহলে বিক্রি বৃদ্ধি পেলে চার বছরের মধ্যে ব্রেক-ইভেনে পৌঁছে যাব,' বলেন তিনি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বপ্নের বিক্রি ৩২ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সাব্বির হাসান নাসির বলেন, 'ক্রেতারা তাদের হাঁটা দূরত্বের মধ্যে কেনাকাটা করতে চান, তাই বিপুল সংখ্যক আউটলেট উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।'

স্বপ্ন বলছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিক্রি ও মোট মুনাফা বেড়েছে। দক্ষতার সঙ্গে পরিচালন ব্যয় কমানো হয়েছে, যা অপারেশনাল উন্নয়নে অবদান রেখেছে। সুতরাং, অপারেটিং মুনাফা (সুদবাবদ ব্যয় পরিশোধের আগের মুনাফা) শূন্য দশমিক ২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৩ কোটি টাকা হয়েছে গেল অর্থবছরে।

এছাড়া ন্যূনতম কর বৃদ্ধি রাজস্ব বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে।

স্বপ্নের মতে, গ্রাহকদের অভিনব সেবা দেওয়া, বিকশিত সরকারি বিধিবিধান ও অসম ভ্যাট কাঠামো থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তারা বিক্রি ও মুনাফা বৃদ্ধিতে অভিযোজনযোগ্যতা এবং কৌশলগত দক্ষতার ওপর জোর দেয়।

প্রবৃদ্ধির জন্য স্বপ্ন ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করেছে, যদিও ঋণের ফলে নিট লোকসান পুঞ্জীভূত হয়েছে। তবে, ব্যবসা বাড়াতে স্বপ্ন একটিকে অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে দেখে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।

চেইনশপটি বলছে, 'গ্লোবাল ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীরা আমাদের সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটি আমাদের ব্যবসায়িক মডেলের আকর্ষণ ও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার কারণে হয়েছে। তবে, আমরা কৌশলগত উদ্যোগের অংশ হিসেবে মূলধন পুনর্গঠন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি।'

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

4h ago