মেয়াদপূর্তির পরও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না প্রায় ১০ লাখ বিমা গ্রাহক

বিমা
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

তারল্য সংকটের কারণে দেশের ২৯ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ না করায় অন্তত ১০ লাখ গ্রাহকের বিমা দাবি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের বিমাখাত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত চার বছরে গ্রাহকদের দুই হাজার ৭০ কোটি টাকার বিমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো। এটি মোট বিমা দাবির ৪০ দশমিক ৪২ শতাংশ।

একই সময়ে আরও মোট তিন হাজার ৫০ কোটি টাকার বিমা দাবি অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে।

বিমা দাবি না পাওয়া এমনই এক গ্রাহক লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপটানা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম।

তিনি ২০১০ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ১০ বছরের মেয়াদি পলিসি নেন। এরপর ২০২০ সালে তার বিমার মেয়াদ পূর্ণ হয়।

মেয়াদ শেষে রফিকুলের পাওয়ার কথা মোট এক লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু, মেয়াদপূর্তির পরও রফিকুলের টাকা পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি।

৫৫ বছর বয়সী দিনমজুর রফিকুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বিমার মেয়াদ তিন বছর আগে পূর্ণ হয়েছে। তারপরও তারা আমাকে টাকা দিচ্ছে না।'

ভারাক্রান্ত গলায় তিনি আরও বলেন, 'এত কষ্টের টাকা ধীরে ধীরে জমিয়েছি। এখন এই টাকা পাবো কি না, জানি না।'

'যখন বিমা করলাম, তখন তো ভেবেছিলাম যে এটা একদিন আমার উপকারে আসবে। কিন্তু তা তো হলো না। বিমা করে ভুল করেছি,' যোগ করেন তিনি।

বিমা আইন ২০১০ অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে৷

গত ১২ অক্টোবর এক বৈঠকে দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বিমা দাবি নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে আইডিআরএ।

এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সানলাইফ ইনসিওরেন্সকে তাদের জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে।

যে ২৯ বিমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। প্রতিষ্ঠানটির বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার মাত্র এক শতাংশ।

আইডিআরএর তথ্য অনুসারে, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার পাঁচ শতাংশ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ছয় শতাংশ ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৪ শতাংশ।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের অমীমাংসিত বিমা দাবির পরিমাণ দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বিমা দাবির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি গত ৪ বছরে ১৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের ভাষ্য, প্রতিষ্ঠানটির মালিকরা জেলে থাকা অবস্থায় বিমা দাবির অনেক টাকা জমে গেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি এখন 'অসুস্থ'।

তিনি বলেন, 'বিমা দাবি দিতে না পারায় কোম্পানির অনেক বদনাম হয়েছে। ফলে, নতুন করে আর কেউ পলিসি খুলছেন না। এতে করে বিমা দাবি পরিশোধের জন্য নগদ অর্থেরও সংকট তৈরি হয়েছে।'

তিনি জানান, এর আগে বিমা দাবি পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠানটি তাদের কেনা জমি বিক্রির চেষ্টা করেছে। কিন্তু সম্ভাব্য ক্রেতারা ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দাম দিতে চাওয়ায় তা বিক্রি করা যায়নি।

আইডিআরএর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিমা প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং ৪৩২ কোটি টাকার হিসাব অনিয়মও ধরা পড়েছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। বর্তমানে স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ পরিচালনা করছে।

এ দিকে, গত ৪ বছরে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্সের অমীমাংসিত বিমা দাবির পরিমাণ ১৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। একই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সাত কোটি ২৭ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।

প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাজাহান আজাদীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

প্রতিষ্ঠানটির সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচ দাবি করেন, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই বিমা কোম্পানিতে নানা অনিয়ম হয়েছে। এরপর থেকে দিন দিন বিমা দাবি কেবল জমতে শুরু করে।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া, গত কয়েক বছরে নতুন পলিসি বিক্রি কমায় প্রতিষ্ঠানটির আয়ও কমেছে।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকদের বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি করা না হলে তা এই খাত সম্পর্কই মানুষের কাছে খারাপ বার্তা দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিমা কোম্পানি সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হয়ে গেলে ভালো কোম্পানিগুলোর জন্যও ব্যবসা চালানো এবং টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।'

তিনি আরও বলেন, 'বকেয়া বিমা দাবি পরিশোধের জন্য ইডরা তিন বিমা প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে এ ক্ষেত্রে সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ।'

সরকার কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ খাত ভালো অবস্থানে ফিরবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, সময় মতো বিমা দাবি নিষ্পত্তি না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি বলেন, 'এর ফলে মানুষ ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার ব্যাপারে আস্থা হারাবে। সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাত বড় ধাক্কা খাবে।'

আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেসব প্রতিষ্ঠান সময়মতো বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না, তাদের সবার একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে লাইফ ফান্ডে পর্যাপ্ত অর্থ নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত সীমার বেশি খরচ করেছে এবং নানাভাবে অর্থ অপচয় করেছে।'

আইডিআরএর এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কম লাভজনক ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করেছে। তাই তারা গ্রাহকের দাবি পূরণ করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে জয়নুল বারী বলেন, 'কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের নামে অনিয়ম করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago