টাকার অবমূল্যায়নের পুরো সুবিধা পাচ্ছেন না রপ্তানিকারকরা
চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়ের কারণে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পূর্ণ সুবিধা নিতে পারছেন না বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা।
কোনো দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে সেই দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে পারে। কারণ, ক্রেতারা অতীতের তুলনায় কম দামের প্রস্তাব দিলেও উৎপাদনকারীরা অর্ডার নিতে পারেন, যা বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।
সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে সরকার বিনিময় হার সামঞ্জস্য করায় টাকার প্রায় ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। সেই অনুযায়ী, আমদানি বিলের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ও রপ্তানি আয়ে ১১০ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডলারপ্রতি টাকার বিনিময় হার ছিল প্রায় ৮৫ টাকা। এরপর থেকেই টাকার দরপতন শুরু হয়।
গত দেড় বছর ধরে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কারণ প্রয়োজন অনুযায়ী রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়েনি, কিন্তু আমদানি বিলসহ বাহ্যিক পেমেন্ট পরিশোধের চাপ ছিল।
এর আগে, স্থানীয় রপ্তানিকারকরা মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কারণ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ তাদের নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়নের সুবিধা ভোগ করছিল।
কিন্তু, বাহ্যিক পেমেন্টের ক্রমবর্ধমান চাপ, মার্কিন ডলার ও অন্যান্য প্রধান মুদ্রার তুলনায় টাকা দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়নের পর বাংলাদেশের রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। রপ্তানিকারকরা ডলারের বিপরীতে টাকার দিক থেকে বেশি রিটার্ন উপভোগ করছেন।
এ ছাড়াও, এটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশি বাজার থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
কিন্তু, গত এক বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে, যা প্রায় নয় শতাংশের কাছাকাছি। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি লাভের অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে।
রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি কাঁচামাল, পরিবহন ও জ্বালানির দাম প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে, এতে ব্যবসায়িক খরচ ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
তারপরও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে গত বছরের তুলনায় স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রায় ৭১ শতাংশ বেড়েছে।
এর কারণ হলো উৎপাদনকারীরা আন্তর্জাতিক পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর নির্ধারিত লিড টাইম ধরে রাখতে আমদানির পরিবর্তে আরও সহজলভ্য কাঁচামাল বেছে নিচ্ছেন।
ফলে, পোশাক উৎপাদনকারীরা তীব্র ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ও সারা বছর পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি করা সুতা ও কাপড়ের ওপর তাদের অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাচ্ছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, 'আমরা অবশ্যই টাকার অবমূল্যায়নের সুবিধা পাচ্ছি, কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়ের কারণে আমরা এই সুবিধা ধরে রাখতে পারছি না।'
তিনি জানান, এখান থেকে সুবিধা ধরে রাখতে না পারার আরেকটি কারণ হলো স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহকারীরাও তাদের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন।
'ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারত ও তুরস্কের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের মুদ্রার উল্লেখযোগ্যভাবে অবমূল্যায়ন করেছে, তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে আরও বেশি প্রতিযোগিতা উপভোগ করছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদ এবং তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আমরা পুরোপুরি এই সুবিধা পাচ্ছি না।'
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ২৮ শতাংশ দরপতনের অর্থ এই নয় যে, রপ্তানিকারকরা প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৮ টাকা অতিরিক্ত পাচ্ছেন।
এর কারণ মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ, উচ্চ ব্যাংক সুদের হার ও কাঁচামালের দামের সঙ্গে জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ব্যবসার ব্যয় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের সময়ে যদি মুদ্রার অবমূল্যায়ন হতো, তাহলে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বেশি সুবিধা নিতে পারতেন, কারণ সে সময় মূল্যস্ফীতি ও ইউটিলিটি বিল কম ছিল।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় মূল্য সংযোজনের দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন রপ্তানিকারকদের সহায়তা করেছে।
তিনি জানান, এ অবস্থায় রপ্তানিকারকরা স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল কিনতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, এই দৃষ্টিকোণ থেকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তাদের প্রতিযোগিতা বেড়েছে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তবে, অন্যান্য খরচ অপরিবর্তিত থাকলে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়ত।
তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানিকারকরা দাবি করেছেন ব্যয়বৃদ্ধির কারণে তারা এই সুবিধা ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু তা পুরোপুরি সত্য নয়।'
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রপ্তানিকারকদের দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ায়। কারণ ক্রেতারা অতীতের তুলনায় কম দাম দিলেও তারা অর্ডার নিতে পারেন। এতে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা বাড়ে।'
তিনি স্বীকার করেন, জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এরপরও রপ্তানিকারকদের সামগ্রিক আয় বেড়েছে, যে কারণে তারা অতিরিক্ত ব্যয় বহন করে নতুন অর্ডার নিতে পারছেন।
Comments