রপ্তানি আয়ের নতুন উৎস তুলাবর্জ্য
তুলাবর্জ্য থেকে অর্থ আয়ের নতুন পথ খুলেছে। এটি এখন ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশে বিক্রি হচ্ছে। যদিও দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরা এটি বিদেশে বিক্রি না করে দেশে পুনর্ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তুলাবর্জ্য আসে সুতা, বয়ন ও বস্ত্রশিল্পে উত্পাদিত কাপড়ের বর্জ্য থেকে। ফেলে দেওয়া তন্তু, সুতা ও কাপড়ের টুকরোগুলো বর্জ্য হলেও তা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে তুলাবর্জ্য রপ্তানি ৭৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। এ থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৪৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪১১ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের তুলাবর্জ্য রপ্তানি করেছে। কয়েক বছর আগেও এ থেকে রপ্তানি আয় ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম।
তুলাবর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পোশাকের টেকসই ব্যবহারের বিষয়ে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তুলাবর্জ্যের চাহিদা বাড়ছে।
পশ্চিমের ক্রেতারা ফাস্ট ফ্যাশনে অভ্যস্ত হওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরাও তুলাবর্জ্যের মতো অন্যান্য টেকসই কাঁচামাল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেন।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় চার লাখ টন তুলাবর্জ্য হয়। সেগুলো পুনর্ব্যবহার করা গেলে তা থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরি করা সম্ভব। চাহিদা থাকায় এখন বেশিরভাগ তুলাবর্জ্য বেশি দামে রপ্তানি হচ্ছে।
সম্প্রতি, সুইডেনের শীর্ষ পোশাক বিক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম পোশাক রপ্তানিকারকদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচা তুলার চেয়ে বেশি পরিমাণ তুলাবর্জ্য ব্যবহার করতে বলেছে। পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতে পোশাকের পুনর্ব্যবহার পছন্দ করে।
এ ছাড়াও, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নতুন প্রস্তাবিত আইনের কারণে এই জোটে তুলাবর্জ্য থেকে তৈরি পোশাকের ব্যবহার বাড়বে।
যেসব কারখানা ২০৩০ সাল থেকে তুলাবর্জ্য ব্যবহার করবে না, তাদের কাছ থেকে পোশাক কিনবে না ইইউ।
এই উদ্যোগটি সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে উঠা সার্কুলার ফ্যাশনের দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সার্কুলার ফ্যাশন হলো একটি ক্লোজড-লুপ সিস্টেম। অর্থাৎ পুরনো উপকরণ ব্যবহার করে নতুন পণ্য তৈরি করা। এটি পোশাক তৈরিতে বর্তমানে ব্যবহার করা প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি বর্জ্যগুলো ভাগাড়ে না ফেলে সেগুলোকে পুনর্ব্যবহারেরও উদ্যোগ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের তুলাবর্জ্য রপ্তানি হয়।'
বিজিএমইএ ইতোমধ্যে তুলাবর্জ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যাতে পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য এ ধরনের কাঁচামাল দেশের বাজারে সহজলভ্য হয়।
তিনি আরও বলেন, 'এর কারণ হচ্ছে তুলাবর্জ্যের বেশি ব্যবহার মানে আরও এতে মূল্য সংযোজন ও আরও কর্মসংস্থান হওয়া। কেননা, বিশ্বব্যাপী তুলাবর্জ্য থেকে তৈরি হওয়া পোশাকের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়ছে।'
দেশে তুলাবর্জ্য বিক্রির ওপর ভ্যাট মওকুফ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'মূল্যবান উপকরণের অপচয় যাতে না হয় সেজন্য তুলাবর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।'
ভালুকাভিত্তিক সিমকো স্পিনিং অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেড বর্তমানে প্রতিদিন ২০ টন পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদন করছে বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুর রউফ।
তিনি আরও জানান, ভালো দাম পেতে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ তুলাবর্জ্য রপ্তানি করায় তার কারখানায় কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
চাহিদা মেটাতে কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ালে ঘাটতি আরও বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'স্থানীয় বাজারে তুলাবর্জ্যের দাম ও চাহিদা বেশি।'
বিজিএমইএর সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ প্রকল্পের স্থায়ী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক বিদিয়া অমৃত খান ডেইলি স্টারকে জানান, স্থানীয় অনেক কারখানা ইতোমধ্যে তুলাবর্জ্য থেকে পোশাক উৎপাদন শুরু করেছে।
তিনি বলেন, 'গত এক দশকে দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা মূলত কারখানা সংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনে চলায় ব্যস্ত ছিলেন। এখন তারা সার্কুলার ফ্যাশন ও নতুন প্রযুক্তি স্থাপনের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আশা করা যায়, আরও অনেক কারখানা তুলাবর্জ্য ব্যবহার করবে এবং বিশ্ব বাজারের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেবে।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে তুলাবর্জ্য উৎপাদন কম হওয়ায় সুতা উৎপাদকরা পর্যাপ্ত পরিমাণ তুলাবর্জ্য পাচ্ছেন না।'
তবে বিশ্বব্যাপী পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় তুলাবর্জ্য থেকে সুতার উত্পাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় অনেক কারখানায় তুলাবর্জ্যের সঙ্গে নতুন তুলা মিশিয়ে সুতা উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু তুলাবর্জ্য থেকে সুতার উৎপাদন কম হওয়ার মানে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাপী এই পণ্যের আকাশছোঁয়া চাহিদা থাকলেও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে পোশাক তৈরির সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
তুলাবর্জ্য নিয়ে কাজ করা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান রিভার্স রিসোর্সেস ও বিজিএমইএর যৌথ উদ্যোগে গ্লোবাল ফ্যাশন এজেন্ডা পরিচালিত সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ প্রকল্পের তথ্যে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার টন তুলাবর্জ্য উৎপাদন করেছে। এর প্রায় অর্ধেক ছিল ১০০ শতাংশ খাঁটি তুলা।
যদি এই তুলাবর্জ্য দেশে পুনর্ব্যবহার করা হতো তবে তুলা আমদানি কমে যেত প্রায় ১৫ শতাংশ। সাশ্রয় হতো ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ সুতা আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ২০১৯ সালে প্রায় এক দশমিক ৬৩ মিলিয়ন টন তুলা আমদানি করা হয়। এর আনুমানিক দাম সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার।
Comments