যেভাবে চলছে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমিরের খামার 'দ্য রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের' ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মন্দা দেখা দেয়। তবে কুমির ও কুমিরের চামড়া রপ্তানি নির্ভর এই প্রতিষ্ঠানটি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামের খামারটি মহামারির সময় বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসময় অনেক কুমির খাদ্য সংকটে মারা যায় এবং প্রায় ২ বছরের জন্য কুমিরের চামড়া রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ থাকে।
খামার কর্তৃপক্ষ এ বছরের আটকে থাকা ২ হাজার চামড়া রপ্তানি আদেশ পূরণের পাশাপাশি আগামী বছরের শুরুতে ৫০০ চামড়া রপ্তানির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
খামারের ব্যবস্থাপক আবু সায়েম মোহাম্মদ আরিফ বলেন, 'সারা বিশ্বের মানুষ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মহামারি ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। আমরাও এই সংকটের ভুক্তভোগী।'
প্রয়াত লেখক মুশতাক আহমেদ ও উদ্যোক্তা মেজবাহুল হক ২০০২ সালে কুমির চাষ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যবসাটি শুরু করার জন্য এই ২ উদ্যোক্তা প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন, যার ৪৯ শতাংশ আসে সরকারের ইকুইটি অ্যান্ড অন্ট্র্যাপ্র্যানারশিপ ফান্ড (ইইএফ) থেকে। ইইএফ সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে এই তহবিল দেয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০০৪ সালে ১৫ একর জমির ওপর স্থাপিত এই খামারের অনুমোদন দেয়।
ওই বছর ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে উদ্যোক্তারা মালয়েশিয়া থেকে ১৫ থেকে ২৮ বছর বয়সী লবণাক্ত পানিতে বসবাস করতে সক্ষম ৭৫টি কুমির আমদানি করেন। মালয়েশিয়া থেকে আসার পথে জাহাজে একটি কুমির মারা যায়। পরে খামারে পৌঁছানোর পর আরও ৬টি কুমিরের মৃত্যু হয়।
২০১২ সালে খামারটি কিনে নেন পিকে হালদার। পরবর্তীতে ২০২০ সালে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তার মালিকানা বাতিল করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য হাইকোর্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুমির বিশেষজ্ঞ এনাম হকের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এ বছরের মার্চ থেকে এনাম হক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এনাম বলেন, 'আমরা দেশের এই নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের টিকে থাকার বিষয়টিতে সহায়তা করার জন্য দায়িত্ব নেই। এটি একইসঙ্গে একটি জাতীয় সম্পদ।'
এনাম যখন দায়িত্ব নেন, তখন ১ হাজার ৭০০ কুমির জীবিত থাকলেও বেশ কয়েকটি আহত ও অসুস্থ ছিল। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ এই কুমিরগুলোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এবং তাদেরকে পূর্ণ স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনতে যথাযথ খাবারের জোগান দেয়।
এ মুহূর্তে খামারে আড়াই হাজারেরও বেশি কুমির রয়েছে। ৯৩টি কুমির নতুন শাবক জন্ম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ও আরও ৫০০ কুমিরের গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করার মতো অবস্থায় রয়েছে। চামড়া উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ খামারেই করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় কুমির চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসার মালিক এনাম বলেন, 'ধীরে ধীরে কুমির শাবকের সংখ্যা বাড়বে।'
রেপটাইলস ফার্মের লক্ষ্য হচ্ছে আগামী ৫ বছরের মধ্যে কুমিরের মজুত ২০ হাজারে উন্নীত করা। খামারটির ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার কুমির।
নতুন রপ্তানি পণ্য
এশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশে উচ্চ চাহিদার কারণে কুমিরের চামড়া বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রেপটাইলস ফার্ম গত ৫ বছর ধরে জাপানে কুমিরের চামড়া রপ্তানি করছে। খামার সূত্র জানান, ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো জাপানে ৪৩০টি কুমিরের চামড়া রপ্তানি করে প্রায় ২ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৫০৭টি চামড়া রপ্তানি করা হয়।
এ মুহূর্তে শুধু জাপানে চামড়া রপ্তানি করা হলেও খামারের কর্মকর্তারা জানান, জাপানে আরও বেশি পরিমাণে চামড়া ও অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশেও রপ্তানির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ প্রকল্পের প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি কুমিরের চামড়ার বেচা-কেনা হয়।
চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের ৪০ দেশে কুমিরের খামার রয়েছে।
রেপটাইলস ফার্ম বছরে ১ হাজার চামড়া রপ্তানি করার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে। ১টি চামড়া থেকে আয় হতে পারে ৬০০ থেকে ৭০০ ডলার।
চামড়ার পাশাপাশি অন্যান্য উপাদান, যেমন মাথার খুলি, হাড় ও স্ক্র্যাপ চামড়া বর্জ্যে পরিণত হয়, কারণ স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করার কোনো উপায় নেই। পরিমাণে কম থাকায় রপ্তানিও যৌক্তিক নয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল আলম।
'যদি এই বাই-প্রোডাক্টগুলো দেশে ও বিদেশে বিক্রি করা যেতো, তাহলে প্রতিটি কুমির থেকে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার পর্যন্ত উপার্জন করা সম্ভব ছিল', যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপনার পাশাপাশি রেপটাইলস ফার্ম বোর্ডের অন্যতম পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী রফিকুল আলম বলেন, 'এতে খামারটি আরও আর্থিক সহায়তা পাবে।'
অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিংগাপুর, চীন ও আমেরিকা মহাদেশে কুমিরের মাংস খাবার হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ ডলারে প্রতি কেজি কুমিরের মাংস বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ থেকে এই পণ্য রপ্তানির অনুমতি না থাকায় মাংসগুলো ফেলে দেওয়া হয়। রফিকুল আলমের মতে, দেশের বড় হোটেলগুলোতে বিদেশিদের কাছে এই মাংস বিক্রির অনুমতি দেওয়া হলে খামারটি বছরে ৫ থেকে ৬ টন মাংস বিক্রি করতে পারবে।
খামারের ব্যবস্থাপক আরিফ জানান, কুমিরের চামড়া দিয়ে বিলাসবহুল হ্যান্ডব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট, বুট জুতা ও অন্যান্য উপকরণ তৈরি করা হয়।
কুমিরের দাঁত, স্ক্র্যাপ চামড়া ও অন্যান্য বাই-প্রোডাক্ট ব্যবহার করে কেতাদুরস্ত পণ্য, মালা, গয়না, গয়নার বাক্স, ওয়ালেট, ঘর সাজানোর উপকরণ ও পার্স তৈরি করা সম্ভব। কুমিরের হাড় দিয়ে তৈরি কাঠকয়লা বিশ্বজুড়ে সুগন্ধি পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে জনপ্রিয়।
একটি কুমির শাবককে লালন পালন করে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গড়ে তোলার মোট প্রাক্কলিত খরচ ২৫০ ডলার। একটি কুমির ৩ বছরের মধ্যে চামড়া বিক্রির পর্যায়ে পৌঁছায় এবং প্রজনন সক্ষমতা অর্জন করতে এই প্রাণীর সময় লাগে ১০ বছর।
১ থেকে ৩ বছর বয়সী কুমিরগুলোকে খাবার হিসেবে মুরগী, গরুর মাংসের কিমা ও ছোট মাছ দেওয়া হয়। ৩ বছর ও তারচেয়ে বেশি বয়সী কুমিরকে সপ্তাহে ১ বার একই খাবার দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের খাবার হজম করতে বেশি সময় লাগে দেখে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
খামারটিতে এ বছর ফল ও ঔষধি গাছের প্রায় ৭ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। ফলে খামারে এখন মোট গাছের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার। কুমিরের বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ রেপটাইলস ফার্মকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী মাসে সেখানে একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র চালু হতে যাচ্ছে। এটি খামারকে আর্থিক ভাবে আরও শক্তিশালী করবে।
'চাষ ও পর্যটন উভয়ই শত শত স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য আরও চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করবে', যোগ করেন এনাম।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments