ফ্যাসিবাদ, সেলফ-সেন্সরশিপ ও ‘নতুন বাংলাদেশ’

ফ্যাসিবাদের জন্ম সাধারণত এমন পরিস্থিতিতেই হয়—যেখানে নির্দিষ্ট কিছু আদর্শ পুরো জনতার মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এক কাল্পনিক ‘অন্য’ তৈরি করে সব ভিন্নমতকে সেখানে ঠেলে দিয়ে তাদের ওপর সেই আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

আমাদের দেশের বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'ফ্যাসিবাদ' এখন একটি নিয়মিত শব্দ হয়ে উঠেছে। তাদের আলোচনা-পর্যালোচনার কেন্দ্রীয় স্থানে 'বৈষম্যবিরোধী' কথাটির সঙ্গে এখন ফ্যাসিবাদের কথাও চলে আসছে।

অধিকাংশ সময়েই এই শব্দটি শুধুমাত্র বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও এর সহযোগীদের বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু 'ফ্যাসিবাদ' বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়, তা এসব আলোচনায় খুব একটা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা হয় না। বরং সেন্সরশিপ, আনুগত্য ও স্বৈরশাসন—এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়কেই ফ্যাসিবাদের চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

কিন্তু ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তিগত ধারণাটি এতো সরল নয়, বরং আরও বেশি জটিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর রূপ অনুসন্ধান করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একই মাত্রায় না হলেও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের অনুরূপ প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে এত তীব্রতার সঙ্গে 'ফ্যাসিস্ট' হিসেবে কোনো সরকারকে চিহ্নিত করা হয়নি।

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের স্বৈরাচার শাসন এবং সর্বস্তরে সেই নিপীড়নের প্রতিফলন ভয়ংকরভাবে হয়েছে এবং এ পর্যায়ের পরিস্থিতি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত আর হয়নি। কিন্তু আমরা যদি এ ধরনের আরও একটি শাসনের উত্থান এড়াতে চাই, তাহলে 'ফ্যাসিবাদ' কী, তা আরও বৃহৎ পরিসরে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক বক্তৃতায় 'ফ্যাসিবাদ' সম্ভবত সবচেয়ে ভুলভাবে ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে আক্রমণ অথবা চাঞ্চল্যকর শিরোনাম হিসেবে দায়িত্বহীনতার সঙ্গে এর ব্যবহার হরহামেশাই করা হচ্ছে।

প্রচলিতভাবে, এই শব্দটি অতি-ডান, স্বৈরাচারী এবং অতি-রক্ষণশীল রাজনৈতিক আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং একজন একনায়ক নেতা, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, সামরিকতন্ত্র এবং বিরোধীদের দমন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু 'ফ্যাসিবাদ' এতো সরল বিষয় নয়।

ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করার সময় একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো স্বৈরাচারী সরকারের নির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতির মধ্যেই একে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। উদাহরণস্বরূপ, শুধুমাত্র মুসোলিনির ইতালি বা হিটলারের জার্মানি কিছু কৌশল ব্যবহার করেছিল বলে সেই কৌশলগুলোই শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদের চিহ্ন, তা সঠিক নয়। ধারণা হিসেবে, ফ্যাসিবাদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই, বরং—এটি একটি বিমূর্ত ধারণা, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করার একটি কাঠামো।

ফ্যাসিবাদের চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, খুব দেরি হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারে না যে তারা ফ্যাসিবাদের শিকার হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ যেহেতু একটি একক ধারণা নয়, তাই এর শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াও খুব সহজ হয়ে ওঠে না। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না যে স্পেনে ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্কোর শাসন এবং আর্জেন্টিনায় হুয়ান পেরনের সরকারই ফ্যাসিবাদের প্রকৃত উদাহরণ এবং সেই শাসন পদ্ধতি চিহ্নিত করা ও ভেঙে ফেলার মাধ্যমেই ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব। যদি তাই হতো, তাহলে বিশ্ব পরবর্তীতে আবারও ইতালিতে দূর-বামপন্থী সামরিক গোষ্ঠী রেড ব্রিগেডসর উত্থান দেখত না।

১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ক্যাপিটালিজম উৎখাত করে একটি মার্কসবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল রেডস ব্রিগেডস। তাদের পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিল হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাস; বিশেষ করে ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী আল্ডো মোরোকে ১৯৭৮ সালে হত্যা। বামপন্থী আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও রেড ব্রিগেডস একটি সহিংস, স্বৈরাচারী পদ্ধতি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল—তাও ফ্যাসিবাদ।

ফ্যাসিবাদ একটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও অর্থনীতির ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, অধিকাংশ সময়ই যার মূল উপকরণ থাকে জাতীয়তাবাদ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষকে তার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে 'জয় বাংলা' স্লোগান এবং তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জনপ্রিয়তাকে উত্তরাধিকার বলে ব্যবহার করেছেন। এই জাতীয়তাবাদী কাঠামো হাসিনা সরকারকে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন উভয়ের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে একটি কথিত বৃহত্তর স্বার্থের সেবা করার অজুহাতে সীমিত করা হয়েছে।

এ দেশে বিপ্লব-পরবর্তী সমাজে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আরও জটিল রূপ ধারণ করেছে এবং তাদের শনাক্ত করা এখন আরও অনেক কঠিন হয়ে পরেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ বা ফারহান ফায়াজ এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আরও বহু শহীদের অমরত্ব এখন যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের যে ছবি জনমানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে তা সামগ্রিক একটি সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করতে ব্যবহৃত হলেও এখন তা 'মব জাস্টিস'। অন্যভাবে বললে, সব 'অন্য' এর বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের ন্যায্যতার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই 'অন্য' কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে ভিন্ন। শহীদের অমরত্বের ধারণা যেখানে বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করে; বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানেই সেই একই ধারণা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা এবং হিংসার পথ প্রশস্ত করতে পারে।

এর পেছনে একটি প্রধান কারণ, ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার ওপর নির্ভর করে, যেখানে নেতাদের প্রায়শই জাতির মহত্ত্বের প্রতীক হিসেবে, একধরণের মেসিয়ার মতো চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আওয়ামী লীগের জন্য সেই চরিত্র ছিল বঙ্গবন্ধু, বিএনপির জন্য জিয়াউর রহমান, হেফাজতে ইসলামের জন্য শাহ আহমদ শাফি এবং জামায়াতে ইসলামীর জন্য গোলাম আজম।

এটি বলার অর্থ এই নয় যে জনপ্রিয় নেতা মাত্রই ফ্যাসিবাদী, তবে জনপ্রিয়তা এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়তা করে, যেখানে স্বৈরশাসন বিকশিত হতে পারে। জনসমর্থন তাদের এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং এই জনপ্রিয়তা অবশেষে তাদের ফ্যাসিবাদী আদর্শ গড়ে তোলার দিকে ঠেলে দিতে পারে, তা সচেতনভাবেই করা হোক বা না হোক।

অনেকেই এই বিষয়টি দেখতে ব্যর্থ হন যে আজকের জনতার ন্যায়বিচারের আহ্বান এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী বাহিনী দ্বারা বিহারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পিচফর্কিং বা জামায়াতে ইসলামী দ্বারা মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও বাঙালি হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ভয়ংকর এক সাদৃশ্য রয়েছে এবং এসব কাজই একই ধরনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার মধ্যেই পড়ে।

এর মাধ্যমে দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যার উত্থান ঘটে—সেন্সরশিপ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেকে আশা করেছেন যে বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতার নতুন যুগের সূচনা হলো। তবে, বাস্তবতা অন্যরকম প্রমাণিত হচ্ছে। একটি সত্যিকারের স্বাধীন সমাজে সব ধরনের সমালোচনা অনুমোদিত হবে—আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত সম্পর্কে এবং নতুন করে ক্ষমতায় বসানো নেতাদের সম্পর্কেও। পরিবর্তে, আমরা এখন 'আওয়ামী লীগের দালাল', 'শাহবাগী' এবং 'রাজাকার'র মতো ট্যাগগুলো দেখি, যার মূল উদ্দেশ্য বিরোধী মত প্রকাশকে নীরব করা এবং বর্তমান অবস্থার সমালোচনায় বাধা দেওয়া।

এর মাধ্যমে একটি নতুন ধরনের 'সেলফ-সেন্সরশিপ'র উত্থান হয়েছে, যেখানে লেবেলিংয়ের ভয় উন্মুক্ত আলোচনাকে নিরুৎসাহিত করে। ফ্যাসিবাদের জন্ম সাধারণত এমন পরিস্থিতিতেই হয়—যেখানে নির্দিষ্ট কিছু আদর্শ পুরো জনতার মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এক কাল্পনিক 'অন্য' তৈরি করে সব ভিন্নমতকে সেখানে ঠেলে দিয়ে তাদের ওপর সেই আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

ফ্যাসিবাদের রেসিপি এবং বাংলাদেশের জন্য বের হওয়ার পথ সম্ভবত ইতিহাসবিদ জর্জ মোসের কাজের মাধ্যমে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়, যিনি নাৎসি জার্মানি থেকে পালানোর পর ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি অনুসন্ধানে তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

মোসে উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র বৌদ্ধিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পূর্বসূরিদের থেকেই নয়, বরং আরও বিমূর্ত কিছু থেকে উদ্ভূত হয়। যাকে তিনি বলছেন 'মুড' বা আবেগ। ফ্যাসিবাদের জ্বালানি হিসেবে তিনি নয়টি প্রধান সংগঠিত আবেগ চিহ্নিত করেছিলেন—সংকট, জুলুম, কর্তব্য, পতন, সম্প্রদায়, নিরাপত্তা, সহিংসতা, কর্তৃপক্ষ ও আধিপত্য। একক স্বতন্ত্র নেতার আকাঙ্ক্ষার মতোই এই আবেগগুলোও ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তৈরি করে, যুক্তিবাদী কোনো ধারণা নয়।

মোসের গবেষণা আমাদের 'ফ্যাসিবাদ' শব্দটি অতিরিক্ত ব্যবহার করার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের প্রতি এই লেবেলের অতিরিক্ত এবং অসতর্ক ব্যবহার এর প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। যখন শব্দটির অর্থ হালকা হয়ে যায়, তখন প্রকৃত ফ্যাসিবাদীতা ভয়, জুলুমের ধারণা এবং বিভাজনের আবেগগত ভিত্তি ব্যবহার করে লোকচক্ষুর আড়ালেই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

ফ্যাসিবাদের চেতনা মারা যায়নি এবং এর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা হচ্ছে এটি ফিরে আসা প্রতিরোধে প্রথম উদ্যোগ। যদি আমরা সতর্ক থাকি এবং ফ্যাসিবাদের আবেগগত বিষয়গুলো সঠিকভাবে বোঝার বিষয়ে অনড় থাকি, তাহলে আমাদের সমাজকে একই ভুল পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষা করার পথে হাটতে পারবো।

নাজিফা রাইদাহ্: সাংবাদিক ও গবেষক

Comments

The Daily Star  | English
Awami League leader Matia Chowdhury (1942-2024)

Matia Chowdhury no more

She breathed her last at 12:37pm at Evercare Hospital where she was undergoing treatment

2h ago