কবির চোখে প্রেম

কবিরা চিরকাল নদী-নারী-প্রেম নিয়ে ভাবেন। নানামুখী ভাবনায় মানুষের সামনে হাজির করেন বিভিন্ন অজানা অধ্যায়। আর প্রেম তো কবিতার মতোই অসংজ্ঞায়িত। তবু কবিরা কবিতা রচনা করেন, মতামত দেন।

প্রেমহীন কোনো সৃষ্টি সম্ভব নয়। আর প্রাণীজগতের প্রাচীনতম প্রবৃত্তি হলো কাম। প্রেম অনন্ত, চিরকাল আধুনিক ও মানবিক একটি বিষয়। এই রচনা কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান,  সৈয়দ শামসুল হক,  আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ ও মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রেম বিষয়ক মতামত নিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আর্কষণের চেষ্টা। তাদের বিভিন্ন সময়ের লেখা থেকে এটি গ্রন্থনা করছেন কবি গাজী রফিক।

আলাউদ্দিন আল আজাদ

এমন একটি শব্দ প্রেম, অভিধানে যার অর্থ আছে, কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে, সে অর্থ কি সত্যিই অর্থময় অথবা নিরর্থক? প্রেম সব রকম অর্থকে ছাড়িয়ে যায়, সেখানেই তার অর্থময়তা। সেখানে তার অনন্ত গণিত, তার গ্রহণযোগ্যতা, অপার মহিমা। আকর্ষণ প্রেমের সঙ্গে বিশেষত গোড়া থেকে গভীরভাবে জড়িত। আকর্ষণ পরস্পর। কিন্তু আকর্ষণ প্রথমত কিংবা সম্পূর্ণভাবেই একতরফাও হতে পারে। জীবন ধারণে অবাধ বিচরণের কারণে আকর্ষণটা প্রধানত পুরুষের দিক থেকেই উদগত হতে দেখা যায়, আর সে আকর্ষণ কোনো রমণীর প্রতি। যৌবনকালটাই এর উপযুক্ত সময়। সে আকর্ষণে নারী বিশেষত প্রাচ্য দেশসমূহে ধর্মীয় ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে, আস্তে আস্তে সাড়া দিতে পারেন। কিংবা একেবারে প্রত্যাখ্যান করাও সম্ভব।

শামসুর রাহমান  

প্রেম কাকে বলে? কী তার সংজ্ঞা? প্রেম কি সংজ্ঞার সীমিত ব্র্যাকেটে বাঁধা পড়তে পারে? সত্যি বলতে কী, এক কথায় প্রেম সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। প্রেম কী, এই প্রশ্ন যদি কেউ আমাকে করেন তাহলে আমি সবিনয়ে নিরুত্তর থাকব। কেউ পীড়াপীড়ি করলে সেইন্ট অগাস্টিনের ধরনে বলব, আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানি না, জিজ্ঞেস না করলে আমি জানি। প্রেম তো কত রকমের হয়। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার প্রেম, খোদার প্রতি ধার্মিকের প্রেম, জীবজন্তুর প্রতি মানুষের স্নেহ-মমতা, গাছপালা, লতাগুল্ম এবং ফুলের প্রতি অনুরাগ, নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম ও পুরুষের প্রতি নারীর প্রণয়। 

আমি আমার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে মানব-মানবীর প্রেম বিষয়ে সামান্য কিছু বলতে চেষ্টাশীল হব। একজন পুরুষ হিসেবে বিপরীত লিঙ্গের বিশেষ কারো প্রতি আমি আকৃষ্ট হতে পারি। এটাই স্বাভাবিক, যেহেতু আমি কোনো সাধু-সন্ত কিংবা দরবেশ নই। হিন্দু এবং গ্রীক পুরাণে অবশ্য সাধু-সন্ত, এমনকি দেবতাদেরও রূপসীদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বিবরণ আমরা পাঠ করেছি। লাস্যময়ী কামিনীর রূপের ছটায়, নূপুরের ঝংকারে মুনি ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গের কাহিনীও আমরা জানি। এই ক্ষণিক আকর্ষণকে আর যাই হোক আমরা প্রেম অথবা ভালোবাসা বলতে পারব না। পথ চলতে গিয়ে কিংবা কোনো পার্টিতে কোনো এক নারীকে দেখে ক্ষণিকের সাক্ষাতেই প্রেমের জন্ম হতে পারে, তবে সেজন্য কিছুটা হলেও পূর্বপ্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। পরস্পরের প্রতি টান থাকতে হবে। 

সৈয়দ শামসুল হক

প্রেম বলে কিছু নেই। প্রেম একটা অভিনয়। আসলে আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে শুতে চাই। বিশুদ্ধ এবং কেবলমাত্র শয়ন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দ, সম্পূর্ণ তৃপ্তি, চূড়ান্ত উল্লাস এবং নিঃশেষে বিজয় প্রকৃতি একমাত্র সঙ্গমেই দিয়েছে। কে একজন খুব বড় কবি বলেছিলেন, একটা ভালো কবিতা লিখলে তার যে সুখ হয়, তা রতিসুখের তুল্য। আমি বিশ্বাস করি তাকে। লক্ষ্য করে দেখবে, আমাদের সব সুখানুভূতি আমরা ওই মানদণ্ডে  মেপে থাকি।

আল মাহমুদ

নর-নারীর পারস্পরিক যৌন ও যৌনরাজ্যের ঘোরলাগা অবস্থার নামই বোধহয় প্রেম। একটি বয়সে পুরুষের যৌবনবতী নারীকে দেখলেই ভালো লাগে। এই ভালো লাগাকেই কেউ প্রেম বলে না। এই আকর্ষণের মধ্যে কেউ যদি বিশিষ্ট হয়ে ওঠে তাহলেই বিপদ। ওই বিপদাপন্ন পরিস্থিতিকেই কবিরা প্রেম নামে আখ্যায়িত করেছেন। আমি আমার আকাঙ্খার পরিতৃপ্তির জন্য নারী মাত্রকেই আহ্বান করি না। মাঝেমধ্যে সর্বান্তকরণে কাউকে বাছাই করি। মনে করি এই নারীটিই আমার প্রিয়তমা। তাকে অন্য নারীদের চেয়ে অধিক সুন্দরী হতে হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি নেই। প্রেমের রাজ্যে কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতা নেই। প্রেমিকের কাছে যিনি সুশ্রী তিনিই সুন্দরীতমা। আমি ব্যক্তিগতভাবে শরীরনির্ভর প্রেমে ও কৃতজ্ঞতায় পরিতৃপ্ত। এর মধ্যে কোনো অলৌকিকতার সন্ধান করিনি। মনে করি আমার দেহগত পরিতৃপ্তির কৃতজ্ঞতার নামই আমার প্রেম।

নির্মলেন্দু গুণ

মানব-মানবীর জৈবজীবনের মৌল চেতনা হচ্ছে কাম। শারীরিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার তৃষ্ণা। ওই কাম তৃষ্ণাকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যে মানব-মানবীর শিল্পসম্মত সাংস্কৃতিক আয়োজন থেকে উদ্ভূত হয়েছে প্রেম। আমি মনে করি, প্রেম হচ্ছে কামের ছদ্মবেশ বা মুখোশ। প্রাণীজগতের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আচরণগত পার্থক্য প্রমাণের প্রয়াসই প্রেম সংক্রান্ত ধারণাটিকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করছে। কামমুক্ত প্রেম বা প্লেটোনিক লাভ বলতে তাহলে কিছু কি নেই- এ রকম প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, আছে। এটি হচ্ছে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান ও চরিত্রবতীদের মানসিক ক্রিয়াকাণ্ডের ফসল।

হুমায়ুন আজাদ

বিশ্বসভ্যতায় প্রধান পুঁজিগুলোর একটি হচ্ছে প্রেম। প্রেমের ওপর এখন সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এবং আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেমকেই প্রধান পুঁজি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এর থেকে বিপুল পরিমাণে লাভ অর্জন করা হয়।

প্রেম এখন রাজনীতি, সমাজ, বিপ্লব বা যুদ্ধের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ- টেলিভিশন খুললেই প্রেমের দৃশ্য দেখা যায়। ক্যাসেট বাজালেই প্রেমের কামনা-বাসনা হাহাকার কোলাহল করে ওঠে। কবিতা-উপন্যাস খুললেই পাতায় পাতায় প্রেমের বিকাশ দেখতে পাই। পৃথিবী এখন প্রেমদ্বারা বড় বেশি আক্রান্ত। তবে প্রেম কোনো সাম্প্রতিক ব্যাপার নয়, নারী ও পুরুষের আবির্ভাবের কাল থেকে আমরা এর গরল ও অমৃত পান করে আসছি। প্রাচীন মানুষের কাছে, যেমন ধর্মগ্রন্থগুলোতে বা প্রাচীন সাহিত্য বা প্রাচীন চিত্রকলায় প্রেম ছিল নারী ও পুরুষের শরীরী আকর্ষণের নাম। ধর্মগ্রন্থগুলোতে নারী এবং পুরুষের শারীরিক কামনার তীব্র রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলায় নারী ও পুরুষের দেহ আকর্ষণ ও তীব্র রূপ লাভ করেছিল। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দেহ আকর্ষণও শুধু বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সম লিঙ্গের মধ্যেও তা তীব্র রূপ পরিগ্রহ করেছে। শারীরিক আকর্ষণ শুধু নারী ও পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরুষ ও পুরুষ এবং নারী ও নারীর মধ্যেও তীব্র রূপে দেখা দিয়েছে। প্রাচীন মানুষেরা সৎ ছিলেন। তারা বাস্তব সত্যকে বিমূর্ত ভাবনায় পরিণত করতে পছন্দ করতেন না। তাই তারা শরীরের আকর্ষণকেই ধ্রুব বলে মনে করতেন এবং দুটি দেহের মিলনকেই মনে করতেন প্রেম। রোমান্টিসিজমের উদ্ভবের পর প্রেম দেহকে অতিক্রম করে বিমূর্ত হয়ে ওঠে, রোমান্টিকরা দেহের থেকে হৃদয়ের কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন এবং প্রায় গত দুই'শ বছর ধরে সবাই হৃদয়ের কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

আমার মনে হয় প্রেম মূলত নারী ও পুরুষের শারীরিক কামনা। আমি যে হৃদয়ের কথা বলি তা শরীরকে না পাওয়ার জন্য। বালক-বালিকারা সম্ভবত ১২-১৩ বছর বয়স থেকে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করে, বালকেরা প্রতিবেশের কোনো সুন্দর বালিকার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং বালিকারা ব্যাকুল হয়ে উঠে কোনো সুন্দর বালকের জন্য।

মুহম্মদ নূরুল হুদা

তার সঙ্গেই তো দেখা হলো না আজো। কোথায় যে থাকে? কি তার চেহারা? কত দ্রুত তার রূপ বদল? মুহূর্তেই ত্রিভুবন ঘুরে আসার তার যে কী কুহক কুশল? বলুন, আমার মতো নশ্বর মানুষ তার নাগাল পাই কি করে! বঙ্গ রমণীর শ্যামাঙ্গী রূপের ভেতর তাকে পেয়েও পাইনি। মিশর কুমারীর গোলাপ মহিমার ভেতরেই কি তাকে পেয়েছি? হাওয়াই দ্বীপে প্রশান্ত মহাসাগরের রূপালি ফেনায় একবার হাসতে দেখেছি তাকে, একবার কালোবালির সৈকতে কৃষ্ণ কুমারীরূপে। আন্দালুশিয়ায় বিজন প্রকৃতি তাকে তৈরি করেছে কখনো, কখনো গোবি সাহারার তপ্ত বালুকা সাজিয়ে রেখেছে তার ভঙ্গি, তার সঙ্গে মিলন অর্থাৎ জলের সঙ্গে আগুনের, তারপর ধোঁয়া, সেই ধোঁয়া ছেড়ে কুণ্ডুলী পাকিয়ে পার হয়ে গেছি সাত আসমান। 

প্রেম? আমি তাকে সৃষ্টি করিনি, ধ্বংস করিনি, আমি তাকে আমার মতো ধরে রাখিনি। যে থাকে না, সে আমার নয়, যে থাকে সে-ই কি কেবল আমার? প্রেম, এই অনুচ্চার্য উত্তরহীনতা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, বয়সের পর বয়স। প্রেম, একশ তিয়াত্তর বছর বয়সেও তের বছরের কুমারীর কাছে নতজানু হওয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Tulip resigns as UK minister

Tulip Siddiq, British treasury minister, resigned yesterday after repeated questions about her financial links to the ousted Bangladeshi government run by her aunt Sheikh Hasina.

2h ago