উন্নয়নের পশ্চিমা মডেল আমাদের জন্য কতটা উপযোগী
বর্তমান বাংলাদেশ ও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে উন্নয়ন। কখনো কি ভেবে দেখেছেন উন্নয়ন কি? পাঁকা ঘর তোলাই কি উন্নয়ন? নাকি ফোর-জি থেকে ফাইভ-জি ব্যবহার উন্নয়ন? আবার কেউ বলে জিডিপি হচ্ছে উন্নয়ন। তবে বেশিরভাগ সময় দেখি গাছ কেঁটে সড়ক নির্মাণ হলো উন্নয়ন।
আসলে উন্নয়ন কী? উন্নয়নের সংজ্ঞা খোঁজার জন্য আমরা যদি তাত্ত্বিকদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায়, তাত্ত্বিকরাও একমত হতে পারেননি। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের বিদ্বানরা তাদের নিজস্ব অঙ্গন থেকে উন্নয়নকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। যেমন, একজন অর্থনীতিবিদ ভাবেন, কীভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে উন্নয়ন বলা যায় কিংবা একজন প্রযুক্তি নির্মাতা চিন্তা করবেন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনই উন্নয়ন। তারা নিজ নিজ বিষয় থেকে উন্নয়ন ব্যাখ্যা দান করলেও তা সকলের জন্য সত্য নয়। বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে আমার যা মনে হয়েছে, বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত কোনো বিষয়ের ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো উন্নয়ন।
ইতিবাচক পরিবর্তন উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। কেন না, উপমহাদেশে পশ্চিমাকরণকেই উন্নয়ন বলে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। তাই তো দেশের বিজ্ঞদের প্রায় বলতে শুনবেন, আগামী ১০ বছরে দেশকে সুইজারইল্যান্ড বানিয়ে দেব কিংবা কোনো শহরের রাস্তা ইউরোপের মতো দেখতে। এই উক্তিগুলোতে পরিষ্কার একটা বার্তা রয়েছে যে, ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব উন্নত এবং আমরা অনুন্নত। পশ্চিমাদের মতো হতে পারলেই আমরা উন্নত হবো।
এখন প্রশ্ন হলো, যা ইউরোপের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন তা কি আমার দেশের সংস্কৃতি, পরিবেশ, অর্থনীতির আলোকে কি ইতিবাচক! যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা অর্থনীতির জন্য ভালো হলেও সমাজের অন্যান্য শাখায় তার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সুতরাং পশ্চিমাকরণ কতটুকু উন্নয়ন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্তরায়গুলো কী নিয়ে সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হলে যে কেউ বলবে- অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অতি জনসংখ্যার ঘনত্ব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কার, দুর্নীতি এবং সম্পদের অভাব ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো বাংলাদেশের ইউরোপ হয়ে উঠার সামনের বাঁধা হলেও সেগুলো উন্নয়নের জন্য কি বাঁধা? বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক বলয়ে পশ্চিমা মডেলের উন্নয়ন সর্বদাই প্রশ্নের উদ্রেক করে। যেমন, বর্তমানে কৃষির পরিবর্তে শিল্পায়নের নামে শহরায়নের ঝোঁক লেগেছে। যার পরম লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। নগদ লাভের আশায় গ্রামের লোকেরা কৃষি ছেড়ে শহরে ছুটছে। উন্নয়নের নামে গাছ কেঁটে শহর হচ্ছে, পাহাড় কেটে কৃষি জমি ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন।
উন্নয়নের প্রথম ধাক্কা লেগেছে কৃষকের ওপর। শহরের আশেপাশে কৃষি জমি উধাও হয়ে গিয়েছে, তার ওপর রাস্তা উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত কৃষি জমি দখল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসেব অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৮৫ শতাংশ, ৩৫ বছরে তা কমছে আরও ১০ শতাংশ এবং সাম্প্রতিকালে প্রতিবছর সেটা আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
অধিক ফসল উৎপাদনে আমরা নির্বিচারে কৃষি জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছি। যার কারণে কৃষি জমির উপকারী পোকা, শামুক ও কেচোর সঙ্গে ছোট মাছে প্রাচুর্যতা এখন ইতিহাস মাত্র।
গত কয়েক দশকে কৃষকের সংখ্যা কমেছে এবং শহরে কৃষি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বা মুনাফা বাড়ার কথা থাকলেও উন্নয়নের জোয়ারে কৃষক এখন ঋণগ্রস্থ। কারণ উন্নত প্রযুক্তি ও সার বীজ কেনার জন্য বেশির ভাগ বর্গা চাষীর মূলধন নেই। সেই মূলধন যোগাতে কম সুদে পর্যাপ্ত ঋণ না পেয়ে, উন্নত চাষের জন্য বেসরকারি খাত থেকে ১৯-৬০ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে কৃষকদের এখন দিশেহারা অবস্থা।
তার ওপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ক্যানস্যার। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, এক বছরে ক্যানসার আক্রান্তের ৬৪ শতাংশ ছিল কৃষক। কীটনাশককে সাধুবাদ!
আমাদের শহরগুলো বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভশীলতা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর ৩ শতাংশেরও কম পানি সুপেয়, যার ৩০ শতাংশ আসে ভূগর্ভ থেকে। আমরা ভূগর্ভের এই পানি পান ছাড়া অন্যান্য গৃহস্থালি ও শিল্পের কাজে ব্যবহার করে থাকি। যা সুপেয় পানির চরম অপচয়।
এ ছাড়া গত এক দশকে ঢাকা শহরে পানির স্তর ১ হাজার ফুটের বেশি কমেছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী তা বছরে প্রায় ৩ মিটার করে নেমে যাচ্ছে। এভাবে পানির স্তর কমতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার জন্য অপেক্ষা করছে বড় আকারের ভূমিকম্প কিংবা ভূমিধ্বস। তার সঙ্গে দেখা দিবে তীব্র সুপেয় পানির সংকট যার আভাস আমরা ইতোমধ্যেই পাচ্ছি। শিল্পের উন্নয়নের জন্য বুড়িগঙ্গাকে তো সেই কবেই বলি দেওয়া হয়েছে। এখন একই পথে হাঁটছে কর্ণফুলি ও হালদা। অথচ যা একসময় নিত্য ব্যবহার্য পানির অন্যতম উৎস ছিল।
ভারত বর্ষের আয়ুর্বেদ বা হারবাল চিকিৎসা প্রায় ৫০০০ বছর পুরোনো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনৈবেশিকরা আধুনিকায়নের নামে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। হাজার বছরের বিশ্বাস দুইশত বছরে গুড়িয়ে দেওয়া হলো। অথচ বর্তমান পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থাতেই এখন আয়ুর্বেদের সংযোজন করা হচ্ছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনতার জন্য।
একই অবস্থা আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও। প্রাচীনকালে আমাদের নৌপথ বেশ কার্যকর হলেও, ব্রিটিশ শাসনের জন্য তা খুব একটা উপকারে আসেনি। ব্রিটিশ শাসন সমাপ্তের পরেও আমাদের নৌপথ উন্নয়নের কাজ না হলেও, সড়ক পথ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অসম পানি প্রবাহের কারণে বর্তমানে শতাধিক নদী এখন মৃতপ্রায়। এরও মধ্যে যে কটা নদীপথ টিকে রয়েছে ভবিষ্যতে তা বিলুপ্ত হবে বহুতল ব্রিজের নিচে। আমাদের নৌপথ হতে পারতো যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।
বর্তমান বিশ্ব তথা পশ্চিমা দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া শব্দ হলো 'ইকো ফ্রেন্ডলি' বা পরিবেশবান্ধব যা উন্নয়নের নতুন মডেল। হাস্যকরভাবে, প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের সংস্কৃতি, কৃষি, চিকিৎসা ও জীবনাচরণ অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হলেও আমরা উন্নয়ন তথা পশ্চিমাকরণ করতে গিয়ে আসলে নিজস্বতাই হারিয়েছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, সেন্ট মেরি'জ ইউনিভার্সিটি, টোকেনহাম, লন্ডন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments