গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশিদের স্ট্রোকে মৃত্যুর হার বেশি

গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা। ছবি: সংগৃহীত

প্রবাসে স্ট্রোকে বাংলাদেশিদের মৃত্যু যেন অনেকটাই নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বদেশ-স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং নানা মানসিক চাপের কারণে প্রবাসীদের স্ট্রোকে মৃত্যুর হার বেশি। সাম্প্রতিক করোনা মহামারিতে তা আরও বেড়েছে।

এই পরিস্থিতি থেকে পিছেয়ে নেই ইউরোপের দেশ গ্রিস। দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্ট্রোকে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে গত ১ বছর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।

এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গ্রিসে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১০৯ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০২০ সালের জুন থেকে চলতি বছরের ১২ আগস্ট  পর্যন্ত ৮৬ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এরমধ্যে এ বছরের ৮ মাসে প্রায় ২৭ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন বিভিন্নভাবে।

বাংলাদেশ কমিউনিটির সহায়তায় এথেন্সে দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের কয়েকজনের মরদেহ গ্রিসেই দাফন করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) বিশ্বজিত কুমার পাল জানান, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যক্তি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

তিনি বলেন, 'মৃত্যুর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ ঋণ করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গ্রিসে এসেছেন।  করোনা মহামারির মন্দা পরিস্থিতিতে কর্মহীন প্রবাসীরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে মানসিক চাপে ভোগেন।'

'বেশিরভাগ প্রবাসীই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোকে। তাদের অনেকের বয়সই ৩০-৪০ বছর,' বলেন প্রথম সচিব।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণ পরিশোধের চাপ থাকায় অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা আছে প্রবাসীদের মধ্যে। ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না প্রবাসীরা। এর বাইরে অবৈধভাবে থাকা অনেকের কাজের সুযোগ হয় না। তাদের প্রবাসের জীবনযাপনের খরচ দেশ থেকেই আনতে হয়। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। করোনা মহামারিতে প্রবাসীদের চাপ, দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। এ কারণে গত বছরের  মৃত্যুর হার বেশি।

গ্রিসপ্রবাসী অভিবাসন বিশ্লেষক কামরুজ্জামান ভূইয়া ডালিম বলেন, "করোনার কারণে অনেকের কাজ ছিল না, অর্থনৈতিক সংকট ছিল। আবার অনেকে গ্রিসের পারমিট নবায়ন করতে পারেনি। তাই দেশেও পরিবার পরিজনের কাছে যেতে পারেনি। হতাশায় প্রবাসীদের মধ্যে স্ট্রোকের হার বাড়ে, অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত।'

গ্রিসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগেরই বৈধতা নেই। তাই তাদের চিকিৎসাসেবা পাওয়া অনেক কঠিন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের চিকিৎসায় সহায়তাকারীদের এথেন্সপ্রবাসী মোহাম্মদ ফজলের মতে, বেশিরভাগ বাংলাদেশি মানসিক চাপে ভোগেন।

তিনি বলেন, 'আমি বিভিন্নভাবে মানুষকে হাসপাতাল বা ডাক্তারের ঠিকানা দিয়ে পাঠাই, সঙ্গে করেও নিয়ে যাই। তাদের চেহারায় হতাশা পরিষ্কার ফুটে ওঠে। অবৈধভাবে থাকার কষ্ট, স্বদেশ-স্বজন তাদের মানসিক চাপের মূল কারণ। এ কারণেই স্ট্রোকের শিকার হন।'

প্রায় ৩০ বছর ধরে গ্রিসে আছেন আব্দুর রহিম। তিনি জানান, অনেক বাংলাদেশি ১২-১৩ বছর ধরে বসবাস করেও বৈধতা পাননি। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে এমন অনেকই আছেন যারা বৈধ হতে পারেননি, দেশেও যেতে পারেননি। এসব দুশ্চিন্তায় মারাও গেছেন অনেকে।

গ্রিস অবৈধ হয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়মিত বা বৈধকরণের কার্যক্রম আগামী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশ-গ্রিসের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির অধীনে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বৈধ হওয়ার সুযোগ পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশিদের বড় অংশের দুশ্চিন্তা অনেকাংশে কমে যাবে বলে বিশ্বাস কমিউনিটি নেতাদের।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, 'বৈধতা পেলে অনেকেই উপকৃত হবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করছে কর্মসূচির সফলতার ওপর। এক্ষেত্রে অনিয়মিত প্রবাসীদের পাসর্পোটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সমস্যা নিরসনের দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা ও প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।'

চুক্তির আওতায় প্রতিবছর ৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী বৈধভাবে গ্রিসে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তাই অবৈধভাবে কেউ যেন গ্রিসে পাড়ি না দেন সে আহবান জানিয়েছেন দূতাবাস কর্মকর্তা, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও কমিউনিটি নেতারা।

লেখক: গ্রিসপ্রবাসী সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

One killed in multi-vehicle crash on Dhaka-Mawa highway

The chain of crashes began when a lorry struck a private car from behind on the Mawa-bound lane

33m ago