অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে অংশ নিতে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন প্রবাসীরা

অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট হাউস। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ সংসদে একটি 'আদিবাসী কণ্ঠস্বর' অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গণভোটের সুপারিশ করেছেন। এর পরের সপ্তাহেই সংবিধানের ৪৪ নম্বর ধারা পরিবর্তনের জন্য আরেকটি গণভোটের দাবি করেছেন বিদেশে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিকরা। এদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরাও।

৪৪ নম্বর ধারা সংবিধানের একটি বিস্তৃত নিয়ম, যা প্রার্থীর যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে।

এতে বলা হয়েছে, এক বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি, দেউলিয়া এবং দ্বৈত নাগরিক কেউ ফেডারেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

২০১৭ সালে লেবার পার্টির অর্থমন্ত্রী ক্যাটি গ্যালাঘের এবং বার্নাবি জয়েসসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে দ্বৈত নাগরিক হওয়ার কারণে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে ফেডারেল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।

আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডও ইংল্যান্ডে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে সংসদে প্রবেশের আগেই তিনি সেই নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন।

সিনেটর ডেরিন হিঞ্চ ১৯৬৩ সালে নিউজিল্যান্ড ত্যাগ করেন এবং ১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য তাকেও জন্মগত নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর অ্যান টুমেই এসবিএস ওয়ার্ল্ড নিউজকে বলেছেন, '৪৪ ধারার ধারণা হলো যে, আপনাকে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আন্তরিকভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে এবং এতে কোনো মিশ্র আনুগত্য থাকার সুযোগ নেই। এটাই তো হওয়া উচিত।'

প্রফেসর অ্যান টুমেইয়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জর্জ উইলিয়ামস। তিনি বলেছেন, 'আইনটি আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। সম্ভবত ১০০ বছরেরও বেশি আগে আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা গোপনীয়তা অন্য দেশের কাছে শেয়ার করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। একটি বিদেশি শক্তির নাগরিককে সংসদে তাই আমরা দেখতে চাইনি।'

'অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি বহু-সংস্কৃতির দেশে এখনো এই আইন থাকা উচিত নয়', যোগ করেন তিনি।

নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের ওয়াটসন ইলেক্টোরাল ডিভিশন থেকে ২০১৬ ও ২০১৯ সালে নির্বাচন করেছিলেন সাবেক কাউন্সিলর শাহে জামান টিটু।

তিনিই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি যিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সংবিধানের ৪৪ ধারার কারণে তাকেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়।

শাহে জামান টিটু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চোখের পানি দিয়ে এ দেশে বাংলাদেশিদের ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছি। যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাননি, তারা বুঝতেও পারবেন না এটি কত কঠিন এবং বেদনার।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি অবশ্যই মনে করি, অস্ট্রেলিয়ার মতো বৈচিত্র্যময় একটি পার্লামেন্টের জন্য এই আইন থাকা উচিত নয়।'

ভিক্টোরিয়া রাজ্যের হক আসন থেকে এ বছরের ফেডারেল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান এনামুল হক।

তিনি বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, লেবার ক্ষমতায় এসেই বৈচিত্র্যময় অস্ট্রেলিয়ার নামে যা করছে, তা ভবিষ্যৎ অস্ট্রেলিয়ার জন্য কতটুকু মঙ্গল বয়ে আনবে তা ভেবে দেখা উচিত।'

এবারের ফেডারেল নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিক সাজেদা আক্তার সানজিদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির প্রার্থী হিসেবে। দেশটির প্রধান রাজনৈতিক এই দলটির ৭৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো হিজাব পরা কোনো মুসলিম নারী মনোনয়ন পেলেন।

সাজেদা আক্তার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের ওয়াটসন ইলেক্টোরাল ডিভিশন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাকেও ত্যাগ করতে হয়েছিল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। জানা গেছে, নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি আবার বাংলাদেশি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন।

লেবার সিনেটর ফাতিমা পেম্যান প্রথম পার্লামেন্টারিয়ান, যিনি চেম্বারে হিজাব পরিধান করেন এবং পার্লামেন্টের কনিষ্ঠতম প্রতিনিধিদের একজন। পার্লামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগে তাকে আফগানিস্তানের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছিল।

সিনেটর পেম্যান তার পরিবারের সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন।

তিনি বলেন, 'এটা বিধ্বংসী ছিল। যদিও আমি ৮ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলাম।'

'এটি আমার পরিচয়ের সেই ধরনের অংশ ছিল, যা আসলে আমি ছিলাম এবং আমি যাকে ধারণ করি। সেই সাংস্কৃতিক দিকটি আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে', যোগ করেন তিনি।

ডেপুটি গ্রিনস নেতা মেহরীন ফারুকী তার স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে ১৯৯২ সালে পাকিস্তান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। তার প্রশ্ন, 'অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিবিদদের অন্য দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিতে হবে কেন?'

মেহরীন ফারুকী পার্লামেন্টে দাঁড়ানোর জন্য পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন এবং বলেছেন যে, 'অন্য কাউকে যাতে এই কাজটি করতে না হয় তার জন্য আমি লড়াই করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সংবিধানে এই বিশেষ আইনটি থাকার কোনো কারণ নেই। এটি আসলে গণতন্ত্রে অংশগ্রহণে জনগণকে বাধা দেয়।'

সংবিধানের অন্য যেকোনো ধারার মতো ধারা ৪৪ পরিবর্তন করতে হলেও গণভোটের প্রয়োজন হবে।

১৯০১ সালের পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৪৪টি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৮টি গণভোট সফল হয়েছে।

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

8h ago