খাদ্য নিরাপত্তার প্রশিক্ষণে যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে যাচ্ছেন ১১ কর্মকর্তা

শিক্ষা সফর এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে সরকারি খরচে যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে যাচ্ছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ১১ কর্মকর্তা। কিন্তু এই সফরে উদ্দেশ্য, কী শেখানো হবে এবং কত খরচ হবে—সে বিষয়ে তাদের অনেকেই স্পষ্ট কিছু জানেন না। 

গত ২২ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের সই করা এক আদেশে বলা হয়, মার্চের ৮-১৭ তারিখ বা তার আশেপাশে কোনো সময়ে 'স্টাডি ট্যুর অ্যান্ড ট্রেইনিং অন ফুড সিকিউরিটি, সেফটি, রিস্ক অ্যান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট'-এর ওপর ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নিতে কর্মকর্তারা যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে যাবেন।

কর্মকর্তারা হলেন— খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুজ্জামান ফারুকী, মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী, মো. শাহ্ নেওয়াজ তালুকদার, যুগ্ম সচিব এ কে এম মামুনুর রশীদ, উপসচিব মো. সহিদুজ্জামান, সৌরেন্দ্র নাথ সাহা, মো. কামরুজ্জামান, হুরে জান্নাত, মর্জিনা আক্তার ও মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ।

১০ দিনের সফরের এই সময়টি তারা দায়িত্বরত আছেন বলে গণ্য হবে। তাদের সফরের সব খরচ সরকার বহন করবে। যুগ্ম সচিব এ কে এম মামুনুর রশীদের স্ত্রী ও কন্যা এই সফরে থাকবেন। তবে তাদের খরচ মামুনুর রশীদ বহন করবেন।

শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্য কী এবং তা কীভাবে দেশের উপকারে আসবে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মজিবর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা এই সফরে যাচ্ছেন তারা দেশে এসে একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন এবং যারা যেতে পারেননি তার সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। শুধু কর্মজীবনে না তাদের পুরো জীবনে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।'

এই সফরে খরচ কত হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'উড়োজাহাজ ভাড়া কত হবে এবং সেখানে গিয়ে কী ধরনের কর্মসূচি হবে তার ওপর নির্ভর করবে সফরের খরচ। এখনো সেভাবে বলা যাচ্ছে না যে কত খরচ হবে। তবে আমাদের অর্থবিভাগ ভালো বলতে পারবে।'

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সমন্বয় ও সংসদ) মো. শাহ্ নেওয়াজ তালুকদারের এই সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারিখ নির্ধারণ হওয়ার পর জানতে পারব আমাদের কী কী বিষয়ে শেখানো হবে। তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আর আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া তো আর এক না। তাদের কিছু পছন্দ না হলে আমরা যে বিষয়ে শিখতে চাই তা তাদের জানাব।'

সফরের খরচ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের যা খরচ হবে সরকার দেবে। সরকার অতিরিক্ত কোনো টাকা দেবে না। সফর শেষ হওয়ার পর আমরা বিল দাখিল করব। এসব সফরে নির্দিষ্ট করে খরচ নির্ধারণ করা থাকে না। বিমানভাড়া বিভিন্ন সময় বাড়ে-কমে। তাই কত খরচ হবে এখনই বলা যাচ্ছে না।'

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট ও অডিট অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব সালমা মমতাজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এই সফরে যাচ্ছি না। আর এই সফরে খরচ কত হবে তাও জানি না। টাকা-পয়সা সবকিছু প্রশাসন বিভাগ থেকে ঠিক করা হয়েছে। আমি কিছু বলতে পারব না।'

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিফ একাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার রোনক সুফিয়া আফছারা রহমানকে সফরের খরচ জানার জন্য কয়েকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে পরিচয় ও বিষয় উল্লেখ করে এসএমএম দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ এই সফরে যাচ্ছেন। সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি এই সফরে যাচ্ছি শুধু এটুকু জানি। এখনো তারিখ নির্ধারণ হয়নি। এ ছাড়া আমি আর কোনো তথ্য দিতে পারব না।'

পরিকল্পনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সফরের তারিখ এখনো নির্ধারণ হয়নি। ভিসা হাতে পেলে বলতে পারব কবে যাচ্ছি।'

যে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাচ্ছেন তা দেশে নেওয়া সম্ভব ছিল কি না বা করোনাকালে দেশের অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনায় এই সফর কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে বলেন, 'আমাদের দেশে সেই ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার উন্নত প্রযুক্তি নেই, তাই দেশের বাইরে যাচ্ছি। তাছাড়া আমরা করোনার কারণে গত ২ বছর দেশের বাইরে কোনো সফরে যাইনি, তাই এখন যাচ্ছি।'

সফরের খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সফরের তারিখ নির্ধারণ না হওয়ায় বরাদ্দ কত হবে তা ঠিক হয়নি। তারিখ নির্ধারণ হওয়ার পর বলতে পারব।'

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম নিজেও এই সফরে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে আমাদের সফরের একটা অনুমোদন আছে।'

খরচের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই বিষয়ে আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। আপনি প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।'

এর আগে প্রশাসন, বাজেট ও অডিট এবং পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে সফরের খরচ বিষয়ে জানতে চাইলে তারাও এ বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সম্পর্কে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালক (গবেষণা) খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের একটা বিষয় যোগ করা থাকে এবং সেখানে বড় অংকের খরচ হয়। বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে আমরা আগেও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েকবার কথাও বলেছি এবং পরিকল্পনামন্ত্রীও এসব সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।'

তিনি বলেন, 'খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যে সফরের কথা বলা হচ্ছে, এ সফরের সামগ্রিক উদ্দেশ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার না। এই সফরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো তথ্যও জানানো হয় না। সরকারের দিক থেকে বাজেট সীমিত রাখার যে নির্দেশনা, এই করোনাকালে এসব সফর কতটা যৌক্তিক তা বিবেচ্য বিষয়।'

তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের সফরে ১১ জন কর্মকর্তা যাওয়ার যে প্রস্তাব সেটি সীমিত করার সুযোগ ছিল কি না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বচ্ছভাবে এ ধরনের সফরের বিষয়গুলো ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানানোর প্রয়োজন আছে। সফরের ব্যয় এবং যৌক্তিকতা জানানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।'

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের প্রশিক্ষণ পেশাগত দায়িত্বের সঙ্গে কতটা যৌক্তিক তা দেখতে হবে। তাছাড়া যে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিদেশ যাওয়া হচ্ছে আমাদের দেশে সে ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কি না তা দেখতে হবে। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তাতে দেশের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি না। এ ধরনের সফর সুবিধা আদায়ে করা হচ্ছে কি না সে বিষয়টি দেখা উচিত। তাছাড়া প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রয়োগে ঘাটতি দেখা যায়।'

তিনি বলেন, 'যে দুইটি দেশে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া হচ্ছে সেই দেশ দুটির আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিত আমাদের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে আমি মনে করি। তাই খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে যাওয়া যৌক্তিক বলে আমি মনে করি না।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago