কেমন হবে কোভিডের চতুর্থ ঢেউ, করণীয় কী
এ বছর এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে করোনা সংক্রমণ গড়ে প্রতিদিন ৫০ জনের নিচে থাকলেও জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করে। গত ২ দিনেই শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার জনের বেশি।
গত ২ সপ্তাহে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ গুণ! জুনের ১১ তারিখে যেখানে সংক্রমণ ছিল ৭১ জন, ২৮ জুনে তা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেল। সংক্রমণের হার এখন প্রায় ১৬ শতাংশ, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। কোভিডের চতুর্থ ঢেউ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ কী? কেমন হবে এবারের কোভিড মহামারির ঢেউ? কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে?
আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো গত বছর এবং তার আগের বছর মে-জুন মাসে করোনা সংক্রমণের তীব্রতা দেখা দেয় এবং জুলাই-আগস্টে সংক্রমণ ঢেউয়ের চূড়ায় পৌঁছে আবার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০২১ সালে মহামারির ঢেউয়ের যে ধরণ ছিল ২০২২ সালে এসেও সম্ভবত আমরা ঢেউয়ের একই ধরণ দেখছি।
২০২১ সালের শুরুতেই যেমন সংক্রমণ বেড়েছিল হুট করে, ঠিক তেমনি এ বছরের শুরুতেও আমরা সংক্রমণের তীব্রতা দেখছি। তবে পার্থক্য হচ্ছে ২০২১ সালের ঢেউ ছিল করোনার সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। আর এ বছরের সংক্রমণ হচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে।
ওমিক্রনের বেশ কয়েকটি উপধরণ শনাক্ত হলেও এর কোনোটিই আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতো মারাত্মক না। ক্রমাগত মিউটেশনের কারণে করোনাভাইরাস এখন অনেক নমনীয় হয়ে গেছে। ভাইরাসের জীবনচক্রে এটাই স্বাভাবিক। ওমিক্রনের সংক্রমণে মারাত্মক কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে কমে গেছে ১০ গুণ।
এ ছাড়া, ওমিক্রন মূলত শ্বাসনালীর উপরিভাগে বেশি সংক্রমণ করে। এই ভ্যারিয়েন্টের ফুসফুসের অভ্যন্তরে সংক্রমণের ক্ষমতা অনেকটা লোপ পেয়েছে। এ কারণে নিউমোনিয়াও আগের চেয়ে কম হচ্ছে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কোভিডের অন্তত ২ ডোজ টিকা পেয়েছেন। আবার গত ২ বছরে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ করোনাভাইরাসে কম-বেশি সংক্রমিত হয়েছে। এই ২ কারণে আমাদের শরীরে করোনাভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। এর ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কোভিড হলেও তা আর আগের মতো মারাত্মক আকার ধারণ করছে না।
বাস্তবতা হচ্ছে, কোভিড একটি রোগ। আর এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে এখনও। মৃত্যু আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে গেলেও, কোভিডে মৃত্যু ঝুঁকি রয়ে গেছে এখনও। অনেকে ইদানীং কোভিডকে ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে তুলনা করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোভিডে মৃত্যুহার ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে প্রায় ১০ গুন বেশি। বিশেষ করে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং যারা বহুবিধ রোগে ভুগছেন, তাদের কোভিড হলে তা জটিল আকার ধারণ করতে পারে এবং এর কারণে মৃত্যুও হতে পারে।
যুক্তরাজ্যে এখন ওমিক্রন ওয়েভ চলছে। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ১৮ হাজার মানুষ, আর মারা যাচ্ছে প্রায় ৬০ জন। অর্থাৎ দৈনিক প্রতি হাজারে কোভিডে প্রাণ হারাচ্ছেন প্রায় ৩ জন। যুক্তরাজ্যে কোভিডে যারা ঝুঁকিপূর্ণ তাদের প্রায় শতভাগ মানুষকেই বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা মারা যাচ্ছেন। বুস্টার ডোজ দিয়েও শতভাগ মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। আর সংক্রমণ তো ঠেকানো যাচ্ছেই না।
যারা টিকার ৩টি ডোজই নিয়েছেন, তাদের শতকরা ৫০ জনই ওমিক্রনে সংক্রমিত হচ্ছেন। তবে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় সবাই কয়েকদিন অসুখে ভুগে আবার সুস্থ হয়ে উঠছেন। অনেকে আবার ২-৩ বারও আক্রান্ত হচ্ছেন। এটাই এখন কোভিডের প্রকৃত চিত্র।
কোভিডের লক্ষণও এখন অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, গায়ে ব্যথা, সর্দি, কাশি, প্রচণ্ড দুর্বলতা এগুলোই এখন কোভিডের প্রধান লক্ষণ। লক্ষণগুলো থাকে সাধারণত ৩-৭ দিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। ৬০ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। অর্থাৎ এখন আর কোভিড হলে অক্সিজেন থেরাপির খুব একটা প্রয়োজন পরে না।
বাংলাদেশে কোভিডের চলমান ঢেউ খুব সম্ভবত জুলাইয়ের শেষ নাগাদ চূড়ায় পৌঁছাবে এবং এরপরে কমতে শুরু করবে। এ বছরের জানুয়ারি-মার্চে ওমিক্রনের যে প্রথম ঢেউ আমরা দেখেছি, এবারের ঢেউ সম্ভবত তারচেয়ে ছোট হবে।
এর কারণ হচ্ছে, আমাদের শরীরে ওমিক্রনের বিপরীতে এন্টিবডির উপস্থিতি ও টিকা। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মেনে চললে এই চতুর্থ ঢেউয়ে সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ ৫-১০ হাজারের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে। ভারতে ওমিক্রনের বর্তমানে মৃত্যুহার প্রতি ২ হাজারে ৩ জন।
আমাদের দেশেও মৃত্যুহার সম্ভবত এর চেয়ে বেশি হবে না। এসব হিসাবের ভিত্তিতে হাসপাতালে পর্যাপ্ত কোভিড বেড ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুত রাখতে পারলে মৃত্যুহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
এখন এটা সর্বজন স্বীকৃত যে শুধুমাত্র টিকা দিয়ে ওমিক্রন সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। ভাইরাসটির এত বেশি মিউটেশন হয়েছে যে বর্তমানের প্রথম প্রজন্মের কোভিড টিকা আর সংক্রমণ ঠেকাতে পারছে না। খুব শিগগির আসছে দ্বিতীয় প্রজন্মের পলিভ্যালেন্ট কোভিড টিকা, যেখানে সকল প্রধান ভ্যারিয়েন্টের অ্যান্টিজেন দেওয়া থাকবে।
ওই নতুন প্রজন্মের টিকা হয়তো ওমিক্রনসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে আরও বেশি সুরক্ষা দেবে। এখনকার টিকাগুলো শুধু মারাত্মক কোভিড থেকে রক্ষা করতে পারে। যারা এখনও টিকার ২ ডোজ সম্পন্ন করেননি, তাদেরকে অবশ্যই দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে নিতে হবে অতি দ্রুত। যারা ২ ডোজ টিকা নেওয়ার পরে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বুস্টার ডোজ নিয়ে চিন্তা না করলেও হবে। সংক্রমণ বুস্টার ডোজ হিসেবে কাজ করে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার মূল হাতিয়ার হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যেমন বাসা থেকে বের হলে আপনাকে অবশ্যই সঠিকভাবে মাস্ক পরে বের হতে হবে। বাসে, ট্রেনে, অফিসে, স্কুল বা কলেজসহ সকল পাবলিক প্লেসে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। বাসার বাইরে যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন কোনো কিছু স্পর্শ না করার। পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখবেন এবং প্রয়োজন হলে ব্যবহার করবেন। কর্মস্থলে সম্ভব হলে কক্ষের জানালা খুলে রাখতে হবে, যাতে বাতাস চলাচলের মাধ্যমে কক্ষে ভাইরাস পার্টিকেল জমে যেতে না পারে।
আপনার শরীরে যদি কোভিডের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই বাসার বাইরে যাবেন না ৫-৭ দিন। তবে এর আগে অসুখের লক্ষণ ভালো হয়ে গেলে স্বাভাবিক কাজে ফিরে যাওয়া যাবে।
কোভিডে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন ষাটোর্ধ মানুষ। এই বয়সের সবাইকেই যত দ্রুত সম্ভব টিকার বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজটি দিতে হবে। বাসায় কারো কোভিড হলে এবং সেই বাসায় কোনো প্রবীণ মানুষ থাকলে তাকে সেইফগার্ড করতে হবে, যাতে তিনি আক্রান্ত না হন। মনে রাখতে হবে, শুধু টিকা দিয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব নয়।
চতুর্থ ঢেউই কেভিডের শেষ ঢেউ নয়। ওমিক্রনই করোনাভাইরাসের শেষ ভ্যারিয়েন্ট নয়। কোভিড মহামারি চলবে আরও কয়েক বছর। সামনের বছরেও আমরা দেখবো নতুন আরও ২-৩টা ঢেউ। তবে খুব সম্ভবত পরবর্তী ঢেউগুলো হবে মৃদু।
করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বাঁচতে শিখতে হবে। লকডাউন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে করোনা থেকে বাঁচা যাবে না। বাঁচার জন্য দরকার টিকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
Comments