হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের ভাষা
লেখাটিতে আমরা সামগ্রিকভাবে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের ভাষার কিছু সাধারণ লক্ষণ বা সূত্র নির্দেশের চেষ্টা করব। একথা মেনেই আলোচনায় এগোচ্ছি যে, হুমায়ূন আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ এবং সার্থক সব উপন্যাসের ভাষায়ই একটা নিজস্বতা ধরা পড়েছে। সেটাই ধরার চেষ্টা করব। এজন্য কখনো কখনো ইতিহাসেও উঁকি দেওয়া লাগতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে সমালোচক পাঠক নির্বিশেষ প্রায় সবাই-ই বলেন যে, তিনি সহজ-সরল চলতি ভাষায় উপন্যাস লিখতেন। গোলাম মুরশিদ বলেছেন, 'পাঠককে নিজের দিকে টানার এবং ধরে রাখার তার আর একটা কৌশল হলো তাঁর ভাষা। ... অনেক বছর থেকেই হুমায়ূন স্রোতের মতো সহজ গতিতে প্রবাহিত হয়- এরকমের একটা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার ভাষা পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না।' হুমায়ূনের ব্যবহৃত ভাষার প্রশংসা করতে গিয়ে এবং তার ভাষার স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে গোলাম মুরশিদ 'আমাদের দেশের' (বোধ করি তিনি বাংলাদেশের বুঝিয়েছেন) ঔপন্যাসিকদের ব্যবহৃত ভাষার একটু নিন্দা-মন্দও করেছেন। তিনি বলেন- 'আমাদের দেশের কথাসাহিত্যের একটা বড় দুর্বলতা হলো আমাদের কথাসাহিত্যের ভাষা-বর্ণনার, তার থেকেও বেশি সংলাপের ভাষা। ... তাদের ভাষাটা স্বচ্ছন্দে পড়া যাচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে অনেক ঔপন্যাসিক সচেতন নন। ... চলতি ভাষার মতো হচ্ছে কি না, তাও একবার বিচার করে দেখেন না।'
গোলাম মুরশিদের মন্তব্য দুটির মধ্যে হুমায়ূনের উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে আমাদের যে-ধারণা হলো, তা অধিকাংশ পাঠক-সমালোচকেরই মন্তব্য। কিন্তু এই গড়-পরতা মন্তব্য দিয়ে উপন্যাসের ভাষায় হুমায়ূনের কৃতিত্ব, নতুনত্ব এবং অবদানকে শনাক্ত করা যায় না। আমরা হুমায়ূনের ভাষার কৃতিত্ব এবং অবদান শনাক্ত করতে চাই। এজন্য বাংলাদেশের উপন্যাসের ভাষার ইতিহাসটির ওপর চোখ বুলানো জরুরি।
বাংলাদেশের উপন্যাসের জন্ম কলকাতার উপন্যাসের গর্ভ থেকে, একথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। যদিও ১৯৪৭-এর পরে বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে যেসব উপন্যাস আমরা পেয়েছি, যেসব উপন্যাসে ধারিত জীবন, তার সংকট, সংস্কৃতি, আবহ ইত্যাদির মধ্যে একটা নতুন স্বর এবং সুরের সাধনা সহজেই চোখে পড়ে, তবুও ভাষার প্রশ্নে তা কলকাতায় জন্ম নেয়া বাংলা উপন্যাসের দারুণ নিকটবর্তী। নিকটবর্তী বলছি এই অর্থে যে, এর ভাষা চোখে পড়ার মতো সংস্কৃত শাসিত; বাক্যগঠন, চলন-বলনের মধ্যে একটা বাড়তি পুস্তকী ওজন লক্ষ করা যায়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসের প্রাতঃকালেই যাকে স্মরণ করা যায়, সেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কথাই উল্লেখ করা যাক। তার উপন্যাসের ভাষা দারুণভাবে নির্মোহ, নির্মম, সংযমী, শিল্পিত। মর্মছেঁড়া কথা তার মতো এত নিঃশব্দে বাংলাদেশের উপন্যাসে খুব কম ঔপন্যাসিকই বলতে পেরেছেন। তবু তার উপন্যাসের বর্ণনার ভাষা চোখে পড়ার মতো সংস্কৃত শব্দবহুল। বাক্যের গাঁথুনি সংস্কৃতের মতোই ওজস্বী এবং আঁটঘাট বাধা; জমাট বাধা। চরিত্রদের সংলাপের ভাষায় পূর্ববাংলার এক বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও, ঔপন্যাসিকের বয়ান-বর্ণনা বাংলা সাহিত্যের প্রথাগত ভাষা-কাঠামোকে মান্য করেছে। বাংলাদেশের উপন্যাসের আরেক পুরোধা শওকত ওসমান।
তার বিভিন্ন উপন্যাসে জীবনবোধের বিভিন্নতার কারণে ভাষাটিও নানা ভাঙচুর ও স্থিতিস্থাপকতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সব উপন্যাসেই অন্তর্লীন থেকেছে শতকত ওসমানের নিজস্ব একটি ভাষাভঙ্গি। এই ভাষাভঙ্গির মৌল প্রবণতা হচ্ছে অপরিচিত অথবা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ আরবি-ফারসি শব্দের সঙ্গে পর্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দের মিশেল। শওকত ওসমানের ভাষা 'অতিপ্রসাধিত'ও বটে। শতকত আলী, সৈয়দ শামসুল হকসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ ঔপন্যাসিকের ভাষাই শ্রেণিশাসিত, আরোপিত কবিত্বপূর্ণ, অভিজাত এবং আবশ্যিকভাবে জটিল। অনেকক্ষেত্রে প্রবন্ধগন্ধী। বাংলাদেশের অধিকাংশ ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের ভাষা তাদের উপন্যাসের বিষয়ের আংশিকতার কারণে, কখনো ঔপন্যাসিকের বেড়ে ওঠা ভাষা-ঐতিহ্যের কারণে, কখনো বা জীবনবোধের অস্বচ্ছতার কারণে বহুমানুষের প্রতিদিনের ঘরের, বাইরের, মর্মের এবং একই সাথে কর্মের সহচর হয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ ঔপন্যাসিকের ভাষা বর্তমানঘনিষ্ঠ যেমন নয়, তেমনি তা ভূগোলের চরিত্র দ্বারা স্বতন্ত্র চরিত্রবান নয়, জননিষ্ঠও নয়। বাংলাদেশের সৃজনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাষার সংকট কেবল উপন্যাসেই নয়, সবক্ষেত্রেই তাঁরা একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র ভাষারীতি দাঁড় করাতে দু-একটা ব্যাতিক্রম ছাড়া ব্যর্থ হয়েছেন।
আহমদ ছফা পূর্ব বাংলার সৃজনশীলদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এক. ইসলামের নামে বিভাগ পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মূল ভাষা-কাঠামোটিকে নষ্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির প্রয়াসে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষার মধ্যে জনমুখ সংশ্লিষ্ট নয়, স্বাভাবিক নয় এমন পর্যাপ্ত আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। দুই. এরই প্রতিক্রিয়ায় 'প্রগতিশীল' ধারার সাহিত্যিকরা 'কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নায়ক সাহিত্যিকদের পুনর্জীবন দান' করেছেন। অর্থাৎ কলকাতার ভাষাকাঠামোটিকে কোনো প্রকার সংগত পরিবর্তন বা ভাঙচুর ছাড়াই ব্যবহার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ উপর্যুক্ত ভাষা-বাস্তবতা এবং ভাষার ইতিহাসের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন এবং উপন্যাসচর্চা করেছেন। কিন্তু হুমায়ূন তার উপন্যাসের ভাষার প্রশ্নে এ-দুয়ের কোনো দিকেই পা বাড়াননি। বরং 'পূর্ব বাঙলার মানুষের মুখের ভাষা এবং লেখ্য ভাষার মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে এনে একে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসার মেধাবী প্রয়াস গ্রহণ' করেছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার।
ঔপনিবেশিকতার ফলে বাংলা ভাষার যেসব পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যে একটা দৃশ্যযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে বাক্যগঠন। বাংলা ভাষা মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সৃজনশীলদের দ্বারা ইংরেজি বাক্য গঠনরীতিকে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। এর ফলে বাংলা বাক্য গঠনরীতিতে দেখা যায় জটিল এবং যৌগিক বাক্যের প্রাদুর্ভাব। উপবাক্য গঠনের যে রীতি, তাও বাংলার ওপর ঔপনিবেশিক ভাষার প্রভাব। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বের যে বাংলা ভাষা, তার সাধনা তো সরল বাক্যের সাধনা। পয়ার ছন্দে সরল বাক্যের গাঁথুনিতে বাংলা ভাষা তার জনগোষ্ঠীর সরল জটিল যৌগিক সব ভাবকেই প্রকাশ করে এসেছে দীর্ঘ ছয়শ বছর ধরে। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা ভাষার বাক্য-কাঠামোর এই নিজস্ব গঠনশৈলীটিকে মান্য করেই গদ্য চর্চা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের ভাষা বিস্ময়করভাবে সরল বাক্যবহুল। জটিল ও যৌগিক বাক্যের প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো কম। আর উপবাক্যের ঔপনিবেশিক মারপ্যাঁচ হুমায়ূন যেন সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। বড় বাক্য না বলে তাকে ভেঙে একাধিক বাক্য করা হুমায়ূনের গদ্যের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। আর এই বাক্যবিন্যাসরীতি সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেছে হুমায়ূনের ভাষায়।
বাক্য বিন্যাসের আদিম, অকৃত্রিম এবং বাংলা ভাষার নিজস্বরীতি-- সরল বাক্য গঠনরীতি- অনুসরণ করার কারণে হুমায়ূনের ভাষা মুখের ভাষার কাছাকাছি চলে এসেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, প্রথাগত ভাষা বিবেচনার মাপকাঠিতে বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের সাধারণত্ব-অসাধারণত্বের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় ভাষা মুখের কাছাকাছি না কি বইয়ের কাছাকাছি। কিন্তু বাক্যবিন্যাসরীতিও ভাষা বিবেচনার অন্যতম মাপকাঠি বলে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। কারণ, উপবাক্য আর মিশ্র বাক্যের আধিক্য ছাড়া সরল বাক্যেই তো সাধারণ মানুষ তাদের যোগাযোগের কাজ সম্পন্ন করে। ফলে, ভাষার সরল বাক্যের প্রাচুর্য ভাষাকে সাধারণ পাঠকের কাছে আপন করে তোলে। হুমায়ূনের উপন্যাসের ভাষার ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি সহজেই চোখে পড়ে। তার ভাষার এই বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ বোধ করি প্রয়োজনহীন। কারণ তার সব উপন্যাসের ভাষাই এই উদাহরণের আওতায় পড়বে।
শব্দ চয়নের প্রশ্নে হুমায়ূন যে-সচেতন তদ্ভববাদী বা সংস্কৃত উপেক্ষাবাদী তা কিন্তু নয়। তিনি শিষ্ট ভাষার অকৃত্রিমতাবাদী। তার ভাষায় ভাবের উচ্চতা, গভীরতা এবং কাব্যিকতা অনুসারে স্থানে স্থানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কষ্টকল্পিত, বহিরারোপিত, জীবনাবেগরহিত নয়, বরং তা ন্যাচারাল। এই গুণটির সাথে উপবাক্য আর মিশ্র বাক্যহীন সরল গদ্যভঙ্গি যুক্ত হয়ে হুমায়ূনের উপন্যাসের ভাষাকে করে তুলেছে অন্তরঙ্গ এবং মুখের ভাষার কাছাকাছি মনোভাবাপন্ন।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে একটি বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্ব এসেছে দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব থেকে। বর্ণনার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিকে হুমায়ূন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। একই বিষয়কে বিভিন্ন 'পারস্পেকটিভ' থেকে দেখার কৌশলকে তিনি অবলম্বন করেন। এই কাজটি যেকোন বড় ঔপন্যাসিককে করতে হয়। তবে সাধারণ ঔপন্যাসিকদের থেকে হুমায়ূনের পার্থক্য হচ্ছে, হুমায়ূন যে বিষয়টিকে দেখবেন বলে স্থির হন, সেই বিষয়টি সম্পর্কে সাদা-কালোর ভেদ পূর্ব থেকে করেন না। অর্থাৎ পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করেন না। খারাপের জন্যে তাঁর যেমন আন্তরিকতা ভালোর জন্যেও তেমন। বড় শিল্পীমাত্রেই এই প্রাথমিক গুণটি থাকতে হয়। হুমায়ূনের তা ছিল। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হুমায়ূন যখন কোনো বিষয়ের বর্ণনা নিজে দেন তখনও তিনি বর্ণনার মধ্যে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রেখে সংশ্লিষ্ট চরিত্রের 'পারস্পেকটিভ' থেকে বর্ণনা করেন। ফলে চরিত্রের নিজস্ব সপ্রাণতার ছোঁয়ায় লেখকের বর্ণনাকে পাঠক আন্তরিক বলে গ্রহণ করে। বর্ণনার এবং 'পারস্পেকটিভের' এই বিশেষ ব্যবহার হুমায়ূনের ভাষার ওপর একটা প্রাঞ্জলতার গুণকে সেঁটে দেয়।
হিউমার হুমায়ূনের উপন্যাসে এক বড় স্থান দখল করে আছে। তিনি নিজেও উপন্যাস-সাহিত্যে হিউমারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে হিউমারের অভাব দেখে তিনি হতাশ হয়েছেন। সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে উপন্যাস সবচেয়ে জীবন-ঘনিষ্ঠ শাখা। অথচ বাংলাদেশের উপন্যাস জীবনের বড় একটি উপাদান হিউমারকে প্রায় বাদ দিয়ে রচিত হয়। হুমায়ূনের ভাষায়- 'হিউমার তো আমাদের সমাজে আমাদের জীবনে এত বেশি কিন্তু আমরা লেখার সময় করি কি- সেখানে হিউমার আপনা থেকেই বাদ পড়ে যায়। লেখাগুলো হয়ে যায় শুকনো, নিরস ...।'
হুমায়ূনের উপন্যাসে হিউমারের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। হিউমারের নানা বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে, এটি দ্রুত সঞ্চরণশীল। অর্থাৎ এর একটি গণ-গ্রাহ্যতার গুণ রয়েছে। একারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ হিউমারের ভাষাকে একটা গণ-গ্রাহ্যতার সীমার মধ্যে থাকতে হয়। অর্থাৎ হিউমারের ভাষা সাধারণত সরল যোগাযোগ-সক্ষম হয়ে থাকে। এটি হচ্ছে হিউমারের জন্য ভাষার মান। কিন্তু উল্টো ঘটনাও ঘটে। হিউমার ভাষার মধ্যে এক ধরনের ফুরফুরে হাওয়া বইয়ে দেয়। পরিবেশ এবং ভাষার মধ্যে এক ধরনের হাস্যোজ্জ্বল নির্ভারতা তৈরি করে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে হিউমারের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি তার ভাষাকে এক ধরনের নির্ভারতা দিয়েছে।
সব ঔপন্যাসিকই জীবনকে দেখেন এবং তার নিজের দেখা জীবনের রূপটি, আবিষ্কারটি অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করেন। এই হিসেবে ঔপন্যাসিক মাত্রই জীবনশিল্পী। কিন্তু এরমধ্যে একটু গোমর বা ফাঁক আছে। জীবনকে যেভাবে দেখেন বা আবিষ্কার করেন, সেভাবে হুবহু তো আর একজন ঔপন্যাসিক উপন্যাসে তুলে ধরতে পারেন না। নানা ভাঙচুর, গ্রহণ-বর্জন, সংযোজন-বিয়োজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক জীবনকে শিল্পিত করে থাকেন। সমস্যাটি ঘটে এই দ্বিতীয় স্তরে। অর্থাৎ আবিষ্কৃত জীবনকে উপস্থাপনের সময়ে। এই পর্বে অনেক ঔপন্যাসিক নানা খপ্পরের খোপে ঢুকে পড়েন। সেটা হতে পারে তত্ত্বের খপ্পর বা আদর্শের কানাগলি বা এমন অনেক কিছু। তখন ঔপন্যাসিকের সামাজিক, তাত্ত্বিক, আদর্শিক বা নৈতিক সত্তাটি প্রাধান্য পায়।
শিল্পী পরাজিত হন, জয়যুক্ত হন ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিসত্তা বা অহং। কিন্তু যিনি প্রকৃত জীবনশিল্পী তিনি আবিষ্কৃত ও দৃষ্ট জীবনকেই সবার ওপরে রাখেন। এক্ষেত্রে জীবন তার সংগতি-অসংগতি, ভাল-মন্দ, সংকট-সম্ভাবনা, সুন্দর-কুৎসিতসহ উপস্থাপিত হয়। ঔপন্যাসিক তখন যেন দর্শক হয়ে যান। ঔপন্যাসিকের অহং তখন তলানিতে নেমে আসে। চরিত্ররা স্বাধীনতা পায়। ঔপন্যাসিক তখন সত্যের দাসে পরিণত হন। এই কাজটি হুমায়ূনের উপন্যাসের পাঠকমাত্রই টের পান। এটি তার উপন্যাসের ভাষাকে স্বচ্ছ, সৎ আর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করেছে বলে মনে করি।
বাংলা কবিতায় ত্রিশের আধুনিক কবিরা নানা নতুনত্ব আমদানি করেছিলেন। প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন ঢের। এর মধ্যে অন্যতম প্রচেষ্টা এবং প্রতিশ্রুতি ছিল কবিতার ভাষা বিষয়ক। তারা কবিতার ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি আনতে চেয়েছিলেন। ত্রিশের কবিরা একটা পর্যায় পর্যন্ত তা করেছেনও বটে। কিন্তু কবিতার ভাষা থেকে বাড়তি কাব্যত্ব ঝরিয়ে কবিতাকে মুখের কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে ত্রিশের কবিদের চেয়ে উত্তর প্রজন্মের বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব বোধ করি সবচেয়ে বেশি। কথ্য ভাষার ভঙ্গি ব্যবহারে শামসুর রাহমানের কবিভাষা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে।
বাংলা উপন্যাসের ভাষাকে তিনি পুস্তকী ঢং, রং ও 'অতিপ্রসাধনতা' থেকে মুক্ত করেছেন। উপন্যাসের ভাষাকে মুখের ভাষার অত্যন্ত কাছে এনে দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর উপন্যাসের ভাষা হয়ে উঠেছে সরল, প্রাঞ্জল, সুখপাঠ্য, যোগাযোগসক্ষম ও আরামদায়ক। একেই বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্যে 'সহজ' ও 'সরল' বলে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু মোহাম্মদ আজম বলেছেন, 'ভাষার সারল্যে কোনো কুড়িয়ে পাওয়া বৈশিষ্ট্য নয় যে এখান-সেখান থেকে খুঁজে পেতে গল্প-উপন্যাসে ব্যবহার করা যেতে পারে।'
খুবই সংগতভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে হুমায়ূনের সরল ভাষার ওজস্বিতা এবং সহ-ক্ষমতা নিয়ে। অর্থাৎ এই ভাষা 'গভীর', 'উন্নত', 'মহৎ' কোনো ভাবের ওজন সহ্য করার ক্ষমতা রাখে কি না! হুমায়ূন তো তাঁর নিজের কাছে বোধ হওয়া 'হালকা' 'ভারি' সকল বোধ-বোধিকে এই ভাষার পিঠে চড়িয়েই ভালোভাবেই পার করলেন। তাঁর ভাষা তো গড়-পরতা কোথাও ভাঙেনি বা মচকায়নি। তবে হ্যাঁ, একথা স্বীকার করতেই হবে যে, হুমায়ূন সব সময় তার নিজের আয়ত্তে থাকা বিষয় নিয়েই উপন্যাসে কাজ করতেন। আয়ত্তের বাইরে তিনি খুব একটা যাননি। এই কাণ্ডজ্ঞান থাকাটা একজন শিল্পীর জন্যে এক অর্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, হিম্মতের বেশি উপরে উঠতে চাওয়াটা অনেক সময় অনেকের জন্যে মহাপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হুমায়ূন- অন্তত ভাষার প্রশ্নে- এই আয়ত্তের বাইরে উঠতে গিয়ে রসাতলে যাওয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছেন বলেই মনে হয়।
Comments