বুকারজয়ী উপন্যাস: জোখা আলহার্থির সিলেস্টিয়াল বডিস

ছবি: সংগৃহীত

ওমানের বুকারজয়ী কথাসাহিত্যিক জোখা আলহার্থির 'সিলেস্টিয়াল বডিস' উপন্যাসে ৩ বোনের বেড়ে ওঠা—তথা একটি পরিবারের কয়েক প্রজন্মের গল্প, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি উঠে এসেছে। ইতিহাসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং পারিবারিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে।

চরিত্ররা বিভিন্ন সময়ের সমাজ ভাবনা ও দ্বান্দ্বিকতার সম্মুখীন হয় বারে বারে। কোনো চরিত্রের সারাটা জীবন কাটে অতিপ্রাকৃত সত্তার শক্তিকে ভয় করে। কোনো চরিত্র আবার সারাজীবন পিঠ কুঁজো করে কাজ করতে করতে একসময় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ওঠে।

জোখা আলহার্থির উপন্যাসটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্কিন অনুবাদক মেরিলিন বুথ। আর উপন্যাসে ওমানের পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা, দাসপ্রথা উপস্থিত আছে উপন্যাটির বিশাল জায়গা জুড়ে।  

অন্যদিকে, ওমানে কেবল ১৯৭০ সালে দাসপ্রথা বাতিল করা হয়। দাসপ্রথার রেশ ও এর জটিল অন্ধকার অধ্যায় উপন্যাসের পরিবারগুলোকে তীব্রভাবে আক্রান্ত করে। 

যেমন, উপন্যাসে দাসত্বের নিষ্পেষণে থাকা অন্তঃসত্ত্বা আনকাবুতাকে দেখা যায় নিজের সদ্যভূমিষ্ঠ কন্যা সন্তানকে মালিকের হাতে তুলে দিতে। মালিকের চোখে নতুন আরেকজন দাস প্রাপ্তির আনন্দ জেগে ওঠে। যেদিন ঘটনাটি ঘটে অর্থাৎ ১৯২৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর — সেদিন দাসপ্রথা বিলুপ্তি এবং দাসপ্রথাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনার লক্ষ্যে জেনেভায় এক দল মানুষ একত্রিত হয়। পাশাপাশি এই ২ ঘটনার উল্লেখ করে জোখা আলহার্থি সম্ভবত স্থান-কাল সৃষ্ট যন্ত্রণা, নিপীড়ন ও বঞ্চনা ধরার চেষ্টা করেছেন। 

এক রৈখিক, প্লট বিহীন বিভিন্ন চরিত্রের গল্প নিয়ে গড়ে ওঠা জোখা আলহার্থির 'সিলেস্টিয়াল বডিস' উপন্যাসটি শুরু হয়েছে, সালিমার ফ্যামিলি ট্রির ছবি দিয়ে; যেখানটায় মিল দেখতে পাওয়া যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড' উপন্যাসের সঙ্গে। বর্ণনায় আবদুল্লাহ'র গল্পের ক্ষেত্রে শুধু উত্তম পুরুষের ব্যবহার করা হয়েছে, আর বাকিটায় নাম পুরুষ। 

উপন্যাসের কাঠামোকে বিবেচনা করা যেতে পারে একটা ধাঁধা হিসেবে, যেখানে প্রতিটা অধ্যায় বিশাল এক ছবির খণ্ডাংশ উপস্থাপন করেছে। আর ভাঙা ভাঙা সেই সব ছবি জোড়া দিলে মূর্ত হয়ে ওঠে মহাকালীন জীবনবোধ। কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না থাকা ওই উপন্যাস জোখা আলহার্থি পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন নিজের মতো ছবি জড়ো করার জন্য।

যদিও উপন্যাসের গল্প ৩ বোনের জীবনকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিলেও, 'সিলেস্টিয়াল বডিসে' মধ্যপ্রাচ্যের জনমানসের বহু দিকই ধরা পড়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই একে মধ্যপ্রাচ্যের ঘরোয়া জীবনের উপন্যাস বলা যাবে না। 

তবে, উপন্যাসে চরিত্র হিসাব করে বললে দেখা যায়- আব্দুল্লাহর স্বপ্নে তার বাবা ক্রমাগত রুদ্র মূর্তি ধারণ করে হাজির হতে থাকে। আবদুল্লাহকে সেই মূর্তি তাড়িয়ে বেড়ায়। ত্রস্ত-বিষাদমাখা জীবন তাকে ক্লান্ত করে তোলে, সে পালিয়ে বাঁচতে চায়। 

মায়ার স্বপ্ন একটা নতুন ঘরের। জীবনের সকল প্রচেষ্টা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। স্বামী আব্দুল্লাহ যখন জিজ্ঞাসা করে সে তাকে ভালবাসে কি না? মায়া কোনো উত্তর দেয় না। মায়া হয়তো ভালবাসা শব্দের অর্থ বোঝে না, কিংবা আব্দুল্লাহর সঙ্গে বিয়ের আগে, যার সঙ্গে মায়া শেষবারের মতো দেখা করতে চেয়েছিল, শুধু তাকেই সে ভালবাসতে পেরেছিল; আর আব্দুল্লাহর সঙ্গে সংসার, সন্তান সবই সামাজিকতা। 

আসমার জগৎ বই নিয়ে। তার বিয়ে হয় একজন চিত্রশিল্পীর সঙ্গে। সেই চিত্রশিল্পী ঘোড়ার ছবি এঁকে যায় ক্রমাগত। আসমা যখন জিজ্ঞেস করে, সে কেন ছবি আঁকে, চিত্রশিল্পী জানায়; তার বাবার কল্পনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সে ছবি আঁকে। 

পিতা ও সন্তানের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব উপন্যাসের বহু জায়গাতেই উপস্থিত হয়েছে। সেই দ্বন্দ্বে কখনো পুরুষতান্ত্রিকতার রূপ, কখনো বা রিপু তাড়িত মানুষের স্বভাবজাত ক্ষোভ, হিংসা ও নিষ্ঠুরতা ধরা পড়েছে উপন্যাসে।  
 
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করা জোখা আলহার্থি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্রুপদী আরবি সাহিত্যে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে সুলতান কাউবোস বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। 

'সিলেস্টিয়াল বডিস' ২০১৯ সালে জিতে নেয় ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সেবারই প্রথম কোনো আরবি ভাষার সাহিত্য পেয়েছিল ম্যানবুকার। এখন পর্যন্ত তিনি মোট ৪টি উপন্যাস, ৩টি গল্প সমগ্র এবং শিশুদের জন্য ৩টি বই লিখেছেন। তার সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, মালয়ালম, গ্রিকসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
 

Comments

The Daily Star  | English
education in Bangladesh

As a nation, we are not focused on education

We have had so many reform commissions, but none on education, reflecting our own sense of priority.

16h ago