বাংলা ঈদ সংখ্যার ঐতিহ্য
ঈদ উপলক্ষে পত্রিকাগুলোতে নিয়ম করে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস, প্রবন্ধসহ বিবিধ উপাদানে আকর্ষণীয় করে তোলা হয় ঈদ সংখ্যাগুলোতে। সঙ্গে থাকে অনেক বিজ্ঞাপনও। ঈদ উৎসবের নানা দিকের মতো ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করাটাও একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
বাংলা পত্রিকার অন্যতম গবেষক স্বপন বসুর মতে, উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা মাতৃভাষা বাংলার চর্চা শুরু করা। তবে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই মূলত মুসলমান সম্পাদিত বাংলা পত্রিকার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। ১৮১৮ থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত মুসলমান সম্পাদিত বাংলা পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুইটি: সমাচার সভারাজেন্দ্র (১৮৩১) ও জগদুদ্দীপক ভাস্কর (১৮৪৬)। প্রথমটি ছিল দ্বিভাষিক; দ্বিতীয়টি পঞ্চভাষিক।
এ ছাড়াও ১৮৬১ সালে ফরিদপুর জেলার ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস আলাহেদাদ খাঁ ফরিদপুর দর্পণ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞাপন দেন। তবে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল কি না তা জানা যায় না। (আনিসুজ্জামান, মুসলিম বাংলার সাহিত্যপত্র) সেই তুলনায় ১৮৭৩ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত ২৯টি পত্রিকা বাঙালি মুসলমান কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মহম্মদী আখবরের (১৮৭৭) ভাষা ছিল মুসলমানি বাংলা, অর্থাৎ প্রচুর আরবি-ফার্সি মিশ্রিত বাংলা ভাষা। বাকিগুলো প্রচলিত বাংলায় প্রকাশিত হতো। বাঙালি মুসলমানের বাংলা চর্চার এই উদ্যম প্রস্ফুটিত হয় অভিনব বিষয় ও বিভিন্ন মতের বৈচিত্র্যময় নতুন নতুন পত্রিকা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে।
এবার নজর ফেরানো যাক কয়েকটি পুরাতন ঈদ সংখ্যার দিকে। প্রথমেই বলতে চাই মাসিক আল্ ইসলাহ পত্রিকার ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে মাসে প্রকাশিত ঈদ সংখ্যা নিয়ে। আল ইসলাহ পত্রিকাটি সিলেট থেকে প্রকাশিত তৎকালের একটি অন্যতম জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রকাশিত এই সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ নূরুল হক।
এই সংখ্যার মোটামুটি সব লেখাই ছিল ঈদ কেন্দ্রিক। নামের মধ্যেই বিষয়বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় যেমন সুফিয়া কামালের (তখন সুফিয়া এন হোসেন নামে লিখতেন) কবিতা 'আমাদের ঈদ', মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কবিতা 'চাঁদ রাত', মুহাম্মদ আব্দুল বারীর গল্প 'সার্থক ঈদ' ও 'পবিত্র ঈদুল ফেতর' নামক প্রবন্ধ।
সুফিয়া কামালের কবিতা দিয়ে সংখ্যাটি শুরু হয়েছে। অনেকটা উদ্বোধনী মেজাজেই লেখা:
'নবীন নূতন হয়ে, বার বার অন্তে বরষের
বহাইয়া প্রাণে প্রাণে প্লাবন সে প্রীতি হরষের
ঈদের হেলাল–
সাম্যের সৌন্দর্যে দীপ্ত, ডাকি বলে যুগের বেলাল।'
এম আশরাফ হোসেন পুরাতত্ত্ববিদের 'মনের বারমাসি' আমার মতে এই সংখ্যার সেরা রচনা। বারমাসির ঢংয়ে আধ্যাত্মিক রচনার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ:
'হৃদয় মন্দিরের মাঝে কুচিন্তার বাজার,
সদায় করে কলরব কঠিন ব্যাপার।
নীরব হইতে পার, বাজার ভাঙ্গিয়া,
জ্ঞানের নয়নে যদি চাও নিরখিয়া।'
আব্দুল বারীর 'সার্থক ঈদ' ব্যক্তিগত পরিসরের ঊর্ধ্বে উঠে সবার মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার গল্প। সন্তানহারা বাবা-মা প্রতিবেশী এতিম অসহায় বাচ্চাদের মধ্যে ঈদের কাপড় ও খাবার বিলিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে নিজের সন্তানের হাসি দেখতে পান।
পুরো সংখ্যায় দুইটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। একটি 'পবিত্র ঈদল ফেতর' অন্যটি 'হজরত শাহজালালের জীবনচরিত'। প্রবন্ধ স্বল্পতার একটি ব্যাখ্যা এই সংখ্যার একটি ছোট গল্প 'গল্পের প্লট'এ পাওয়া যায়। গল্পের নায়ক হবিব বিএ পাশ করে বেকার হয়ে বসে আছে। সে লেখক হতে চায়। বেকার সমস্যা নিয়ে একটি ভারি প্রবন্ধও লিখে ফেলে। কিন্তু কোন সম্পাদকই ছাপানোর আগ্রহ দেখায় না। এক সম্পাদক বলেই ফেলেন,' আজকাল কেহ প্রবন্ধ পড়তে চায় না …বাজারে গল্পের চাহিদাই বেশি, যদি গল্প লিখতে পারেন নিয়ে আসবেন।' বেচারা হবিব গল্পের প্লট খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে চাকরি খোঁজার বিড়ম্বনা নিয়েই গল্প লেখার সিদ্ধান্ত নেন।
পত্রিকার শেষের দিকে ঈদ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হয়। দুইটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি ঈদের দিনে গান গাওয়া, অন্যটি ঈদের দিন নারীদের ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া। বোখারি ও মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে এই দুইটি বিষয়েই মহানবী (সা.) এর অনুমোদন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। তবে নারীদের ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে নিচে একটি পাদটীকায় হাদিস সংকলক বলেন, 'বর্তমানে এতদ্দেশের স্ত্রীলোকদের পক্ষে মান সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া ইসলামী জামায়াতে যোগদান করা নিরাপদ নহে। তজ্জন্য ওলামাগণ এই ছোন্নত পালন না করাই সঙ্গত বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন।'
এই সংখ্যার বিজ্ঞাপনের দিকে তাকালে দেখা যায় ঈদ নিয়ে একটি মাত্রই বিজ্ঞাপন ছিল। ঈদের সওগাত হিসেবে স্বনামধন্য কবি বন্দে আলী মিয়ার ৬টি বইয়ের—পরিহাস, অস্তাচল, আমানুল্লাহ্, ময়নামতীর চর, অনুরাগ ও সুরলীলা—বিজ্ঞাপন। পবিত্র রমজান মাস পর্যন্ত বইগুলোতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।
পত্রিকাটির শেষে সম্পাদক মহাশয় আর্থিক অভাব ও কম্পোজিটরদের অসুস্থতার কারণে পূর্ণাঙ্গসুন্দর একটি ঈদ সংখ্যা উপহার না দিতে পারায় খেদ প্রকাশ করেছেন। পত্রিকার অঙ্গসজ্জাও ছিল খুব সাদামাটা। তবে সেকালের সেরা সব মুসলমান কবি-সাহিত্যিকের লেখা উপহার দেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই তিনি দাবি করতে পারেন।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) সিলেটের মুসলমান সমাজেও দেশাত্মবোধ ও ঐতিহ্যপ্রীতির জাগরণ ঘটায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের মুসলমানদের মাতৃভাষা চর্চায় উৎসাহী করতে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুহম্মদ নুরুল হক প্রথমে হাতে লেখা ত্রৈমাসিক অভিযান ও পরে নাম পরিবর্তন করে মাসিক আল ইসলাহ ছাপানো শুরু করেন। প্রথম সংখ্যাটি অগ্রহায়ণ ১৩৩৯ অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়। ইসলামের উদার ও মহৎ আদর্শ ধারণ করে একটি আদর্শ, মানবিক সমাজ গড়ে তোলায় আল ইসলাহর সাধনা সহজ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ঈদের এই বিশেষ সংখ্যাটিতেও। তবে মফস্বলীয় সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণ ধর্মীয় প্রবণতার ছাপও স্পষ্ট।
দ্বিতীয় ঈদ সংখ্যাটি সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে এই বিশেষ সংখ্যাটি বের হয়। পত্রিকা শুরু হয়েছে বজলুর রহমানের 'ঈদের মোনাজাত' শীর্ষক কবিতা দিয়ে। ইসলামের অতীত ঐশ্বর্য ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে কবি লেখেন:
'ছিলো বুকেতে তাদের
বিশ্ব বিজয়ী বিপুল বল,
ছিলো হাতেতে সবার
তেগ্ হাতিয়ার অচঞ্চল,
ছিলো কণ্ঠে সবার
অভয় বাণী সে সুর-উজ্জ্বল,
বলো, পাবে কি গো ফিরে
কাম্য তাদের সে-সম্বল'
এ ছাড়ও শাহাদাৎ হোসেন, সুফিয়া কামাল ও আজিজুর রহমান ঈদ নিয়ে কবিতা লেখেন। অন্যান্য বিষয়ের কবিতাগুলোর মধ্যে জসীম উদ্দীনের 'জলের ঘাটে', সিরাজুল আলমের 'কালো', শ্রীমণীন্দ্র দত্তের অনুবাদ কবিতা 'কারখানার হুইসল' উল্লেখযোগ্য। আজহারুল ইসলাম বিএ কর্তৃক রুবাইয়াৎ-ই-সাইফ উদদীন বাখারজীর মূল ফার্সি থেকে অনুবাদটিও চমৎকার। একটি অংশ পাঠক-পাঠিকাদের জন্য নিবেদন করা হলো:
'রহম তোমার একই রকম অতীতে ও বর্ত্তমান।
তোমার বাগে কাঁটার পাশে কত গোলাপ স্ফূটমান।
কাজেই বলি, দাওগো খুলি সবার তরে দোর তোমার
ঢুকতে পারে যেন সবাই মাতাল ও বুদ্ধিমান।'
এই সংখ্যায় যেসব প্রবন্ধ ছাপা হয়, তার মধ্যে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর 'লাইব্রেরী', মাহবুব-উল আলমের 'আমাদের ভাষা-বিভ্রাট' এবং বজলুর রহমানের 'আধুনিক বাঙলা কাব্য-সাহিত্য' উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে ইসলামিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ছাপা হয় যেমন আবদুল মওদুদের 'মোগল যুগের উদ্যান-কলা', যামিনীকান্ত সেনের 'বিশ্ব ইসলামের চিত্রকলা', মোহাম্মদ কে চাঁদের 'ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা', মুস্তাফীজুর রহমানের 'দার্শনিক তকীউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া' এবং আবদুল গফুর সিদ্দিকীর 'কারবালার মহাযুদ্ধ'।
এই সংখ্যায় ঈদ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এর মধ্যে অছেল মোল্লা এন্ড কোংয়ের প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা বর্তমানকালের সুপারশপের মত। জুতা, ছাতা, পারফিউম, পোশাক, খেলনা কি নেই তাদের সংগ্রহে। বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন ছিল 'ঈদ উপলক্ষে বিরাট আয়োজন এক স্থানে বসিয়া সবই পাবেন'। পণ্যের তালিকার পাশাপাশি দোকান মালিক খান সাহেব মৌলবি অছেল মোল্লার ছবিও ছাপা হয় বিজ্ঞাপনটিতে।
হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত বিজ্ঞাপনটিও বেশ আকর্ষণীয়। তাদের ট্যাগ লাইন ছিল: 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' ঈদের দিনে আনন্দ দান করিবে। বিজ্ঞাপনটিতে আব্বাসউদ্দীন আহমদের 'ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে', 'ইসলামের ঐ সওদা লয়ে', 'যাবার বেলা সালাম লহ' ও 'এলো আবার ঈদ্' এই চারটি গানের রেকর্ড সহ আরও কিছু শিল্পীর গানের প্রচার চালানো হয়।
আল ইসলাহর ঈদ সংখ্যার মতো মোহাম্মদীর ঈদ সংখ্যারও মূল সুর ইসলামি ভাবাদর্শের ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরের বিকাশ ঘটানো। সাম্প্রদায়িক গণ্ডির বাইরে বেরোতে না পারলেও বিষয় বৈচিত্র্য ও ভাবের দিক থেকে মোহাম্মদীর ঈদ সংখ্যাটি ছিল তুলনামূলকভাবে উদার ও আধুনিক।
সর্বশেষ যে ঈদ সংখ্যা নিয়ে বলতে চাই তা, হলো—মিল্লাতের ১৯৪৬ সালের ঈদ সংখ্যা। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দার্শনিক আবুল হাশিম ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর ঈদুল আজহার দিনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক মিল্লাতের যাত্রা শুরু হয়। তবে প্রাদেশিক লীগের বামপন্থি অংশের অঘোষিত মুখপত্র হিসেবেই পত্রিকাটি পরিচিতি পায়।
ঈদ সংখ্যার শিরোনাম ছিল 'আজিকার দিনেও খাদ্য নষ্ট করবেন না'। ঈদ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চেহারা পাওয়া যায়। ১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গার রেশ তখনো কাটেনি। কিন্তু নিয়ম মাফিক আসমানে উঠে ঈদের চাঁদ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়:
'কি মর্ম্মান্তিক আজিকার এই ঈদের দিন! সদ্য রক্ত-স্নাত কলিকাতার অলিতে-গলিতে পচা শবের দুর্গন্ধে বাতাস এখনো ভারাক্রান্ত। সন্তানহারা জননীর আর্ত্তনাদ অবিশ্রান্ত চলিয়াছে। স্বামীহারা বধূর মূর্চ্ছা এখনো ভাঙে নাই। ক্রন্দনরত মাসুম বাচ্চা নিহত পিতা-মাতাকে খুঁজিয়া খুঁজিয়া হয়রান হইয়া হাত-পা ছুড়িয়া কাঁদিতেছে। আর্ত্তের আর্ত্তনাদে আর আহতের চিৎকারে সমগ্র নগরী এখনও শিহরিয়া শিহরিয়া উঠিতেছে। চিরমুখর নগরবাসী হতবাক, শোকাহত, মর্ম্মাহত, সন্ত্রস্ত। আর এমনি দিনে—সদা কোলাহল-মুখরিত কলিকাতা নগরীর নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় আসমানে উঠিয়াছে ঈদের চাঁদ। মাটীতে কারবালার ক্রন্দনরোল আর আকাশে আনন্দোৎসবের বার্ত্তাবহ। হাসি-কান্নার কী নির্ম্মম ঘূর্ণাবত্ত, আর কী অসহায় এই মাটীর মানুষ।'
বিশাল কলেবরের এই ঈদ সংখ্যাটির বিষয়-সূচীতে সরাসরি ঈদ নিয়ে তিনটি কবিতা ছাপা হয়েছিল—জসীম উদ্দিনের 'ঈদের তারাবি', শাহাদাৎ হোসেনের 'ঈদের সালাম' ও শাহেদা খানমের 'ঈদের কবিতা'। ১৫টি অন্যান্য বিষয়ে কবিতা ছাপা হয়েছিল। ছিল নয়টি গল্প। সবচেয়ে বেশি ছিল প্রবন্ধ—২২টি।
এই সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কাজী নজরুল ইসলামের ছোট বেলায় রচিত দুইটি গান এবং শিয়ারশোল রাজস্কুলে পাঠ্যাবস্থায় তোলা কবির একটি ছবি। একটি গানের কিছু অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না:
'চাষ কর দেহ জমিতে
হবে নানা ফসল এতে।
নামাজে জমি উগালে,
রোজাতে জমি সামলে,
কলেমায় জমিতে মই দিলে,
চিন্তা কিহে এই ভবেতে!'
নজরুল ১৩ বছর বয়সে 'চাষার সং' নামে একটি নাটিকা রচনা করেছিলেন। এই গানটি সেই নাটিকায় ব্যবহার করা হয়েছিল।
এই সংখ্যাতেও সুফিয়া কামালের 'সাড়া' শিরোনামে একটি কবিতা ছাপা হয়। তবে কালের মেজাজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার লেখায়। পূর্বের সাম্য, শান্তির বাণী নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান আর পাকিস্তান আন্দোলনের জোশ:
'নবীন সেনানী বেশে চলে পথ, আধো চাঁদ অঙ্কিত হেলাল,
মঞ্জিলে মঞ্জিলে হাঁকে আজান-এর আওয়াজ বেলাল,
জামাত বাড়িছে পথে, হেরে বেঈমান এজিদেরা।
চমকি উঠিছে 'তূর' আনন্দে অধীর হয় 'হেরা'
সুবহে সাদেকের সাথে জাগিয়া উঠিছে এ কওম,
শুনি সালাতের ধ্বনি -- "আসসালাতে খায়রোম মিনান নওম"।
মঞ্জিলে মঞ্জিলে হাঁকে আজান-এর আওয়াজ বেলাল,
জামাত বাড়িছে পথে, হেরে বেঈমান এজিদেরা।
চমকি উঠিছে 'তূর' আনন্দে অধীর হয় 'হেরা'
সুবহে সাদেকের সাথে জাগিয়া উঠিছে এ কওম,
শুনি সালাতের ধ্বনি—"আসসালাতে খায়রোম মিনান নাওম"।'
প্রবন্ধগুলোতেও চলমান হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ লড়াই কথা বার বার এসেছে। ইতিহাসবিদ আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর 'বাংলার সংস্কৃতির আত্মনিয়ন্ত্রণ' শীর্ষক প্রবন্ধটি বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হওয়ায় কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
'বাঙলায় মুসলমান বা হিন্দুর সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের কথাই উঠতে পারে না, যেমন কথা উঠতে পারে না বাঙলার ওপর উত্তর ভারতীয় তাহ্জীব চাপানোর। বাঙলার সংস্কৃতি হিন্দু-প্রধানও হবে না, মুসলমান-প্রধানও হবে না, এ হবে বাঙালীত্ব-প্রধান, যে বাঙালীত্বের বিকাশে, পুষ্টি ও সংরক্ষণে মুসলমানের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক সক্রিয়তা হিন্দুর চেয়ে অধিক না হলেও সমতুল্য ত বটেই।'
এ ছাড়াও বসুধা চক্রবর্ত্তীর 'মার্কসবাদীর দৃষ্টিতে পাকিস্তান', খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের 'হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি, তালেবুর রহমানের 'জাতীয়তা বনাম বিশ্বজনীনতা' এর মত ভারী প্রবন্ধও ছাপা হয়। ইন্দোচীনের গৌরবময় মুক্তিসংগ্রাম নিয়েও একটি লেখা প্রকাশিত হয় এই সংখ্যায়।
মিল্লাতের ঈদ সংখ্যাটিতে বেশ কয়েকটি নতুন নতুন বিষয়ে রচনা স্থান পায়। এর মধ্যে পটুয়া কামরুল হাসানের স্বাস্থ্য গঠন বিষয়ক রচনা 'ব্যায়াম', আবুল হাসানাতের শরীর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা 'যমজ সন্তান', আলোকচিত্রের কৃৎকৌশল নিয়ে ফজলে লোহনীর 'ফটোগ্রাফির কথা' এবং জহুরুল হকের 'পরমাণু যুগ' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঈদ সংখ্যাটিতে বেশ কয়েকজন উদীয়মান তরুণ সাহিত্যিকের গল্প ছাপা হয়েছিল যারা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্য শীর্ষস্থান অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে রশীদ করিম, আবু রুশদ ও শওকত ওসমানের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।
সর্বোপরি মিল্লাতের ঈদ সংখ্যাটি বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ছিল আধুনিক, প্রাণবন্ত ও প্রগতিশীল। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিসরে এরকম প্রগতিশীল পত্রিকা বের করা নিশ্চয় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। দলীয় পত্রিকার একঘেয়েমি বা বিরক্তিকর প্রচারণার কোন ছাপ সংখ্যাটিতে চোখে পড়েনা। সাধারণ মননশীল পাঠকের উপযোগী করা তোলার সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টা দারুণ ভাবে বিদ্যমান। বর্তমানকালে বিজ্ঞাপনের চাপে ক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক আনুগত্যের চাপে পিষ্ট ঈদ সংখ্যাগুলোর ঐতিহ্যের তালিকায় মিল্লাতের ঈদ সংখ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে কষ্ট হয়।
টীকা: প্রবন্ধে উল্লেখিত ঈদ সংখ্যাগুলো 'বাংলাদেশ অন রেকর্ড'র উদ্যোগে ডিজিটাইজ করা হয়েছে।
সামসুদ্দোজা সাজেন: সাংবাদিক ও গবেষক
sajen1986@gmail.com
Comments