সৈয়দ আবুল মকসুদ স্মরণে
সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ আমি লন্ডনে বসে শুনতে পাই। পারিবারিক কারণে, অতিমারির বাস্তবতা যুক্ত হওয়াতে আমি তখন দীর্ঘদিন প্রবাসে। কয়েক গজ দূরের প্রতিবেশীর চলে যাওয়ার খবর পেলাম পাঁচ হাজার মাইল দূরে বসে। পরিস্থিতির কারণে পাশে থেকেও অনেকে কাছে যেতে পারেন নি জেনে মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল।
মকসুদ ভাইকে জানতাম একজন সাংবাদিক হিসেবে, একজন পাঠকপ্রিয় কলামলেখক হিসেবে। ২০০৩ সালে তিনি বিশেষ করে সবার কাছে পরিচিত হলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন নিজের জন্য বিশেষ পোশাক বেছে নিলেন এবং পণ করলেন যে যতদিন পর্যন্ত আমেরিকার এই আগ্রাসী ভূমিকার অবসান না ঘটবে তিনি ঐ পোশাক ছাড়বেন না জানালেন। এরপরে যখনই পুরানা পল্টনের মুক্তমন্ঞ্চ অথবা প্রেসক্লাবের সামনে বা যেখানেই আমেরিকার ইরাক আক্রমণের বিরুদ্ধে সমাবেশ বা মানববন্ধনের আয়োজন হয়েছে মকসুদ ভাই কখনো অনুপস্থিত থাকেন নি। দুঃখজনক হলো যে মকসুদ ভাই সেই প্রতিবাদী পোশাকটি আর ত্যাগ করতে পারেন নি।
আমি মকসুদ ভাইকে কাছে থেকে চিনেছি, তারিখটা ঠিক মনে পড়ছে না, যখন আমার মা সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর 'নিজেরা করি' তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের কয়েকটা জেলায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমরা কয়েকজন 'নিজেরা করি'র ব্যবস্থাপনায় এক জেলা থেকে আর এক জেলায় গিয়ে সুফিয়া কামাল সম্পর্কে বক্তব্য দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল সুফিয়া কামালকে কেন্দ্র করে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আদর্শকে সাধারণের সাথে পরিচয় করানো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মানুষের মননে সঞ্চারিত করা। এই কাজের জন্য সৈয়দ আবুল মকসুদের নামটা খুবই স্বাভাবিক ভাবে মনে এসেছিল উদ্যোক্তাদের।
সেই সুবাদে আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল। তখনই জানলাম তিনি আমাদের প্রতিবেশী। বলেছিলেন তিনি বাসসে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শাহেদ কামালের সহকর্মী ছিলেন, তার সাথে বা আমার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে বা নিছক গল্প গুজব করতে আমাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। জেনেছিলাম মকসুদ ভাই বাসস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, যখন ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর জঙ্গি আক্রমনকে "ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ" আখ্যায়িত করে একটি লেখা লেখার জন্য বাসস কর্তৃপক্ষ তাকে সতর্ক করে পত্র দিয়েছিল। একজন নাগরিকের বাক্ স্বাধীনতার উপর খবরদারি তিনি মেনে নিতে পারেন নি। সেই অধিকার এর মান রক্ষার জন্য তিনি তার উপার্জনের নিশ্চিত উপায়টি নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আমি পেশাগত ও পারিবারিক কারনে প্রায় ২৫ বছর ঢাকায় বাস করি নাই। তাই সেই সময় যারা আমাদের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তার বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতেন তাদের অনেকের সঙ্গেই দেখা হওয়ার সুযোগ হয় নাই। মকসুদ ভাইও তাদের একজন। যা হোক, সুফিয়া কামালের অনুষ্ঠান উপলক্ষে মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত হয়। জেলায় জেলায় ভ্রমণের সময়ে, সভা শেষে অবসরে তার সাথে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হতো। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি- এ সব কিছু নিয়ে আলোচনায় কখনো আশাবাদী হতে উজ্জীবিত হয়েছি, আবার কখনো হতাশায় আক্রান্ত হয়ে বিষাদ অনুভব করেছি। একেবারে ব্যক্তিগত কথাও স্থান পেয়েছে আমাদের আলাপচারিতায়।
সহকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, যেখানে আমার ভাই শাহেদ কামালের প্রসঙ্গও এসেছে, খুবই নৈর্ব্যক্তিক ভাবে, গুরুত্বের সঙ্গে এক একটা ঘটনা উল্লেখ করতেন তিনি। সেই সব ঘটনা এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করতেন এবং সেই গল্পগুলির মধ্যে এমন রসবোধ থাকতো যে মকসুদ ভাই গল্প শুনতে আমরা সময়ের কোনো হিসাব রাখার তাগিদ অনুভব করতাম না। সে গল্প যে কোন বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এমনকি তাকে বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট করেছিল এমন ঘটনার গল্পও তিনি একইভাবে করে যেতেন। তার কলামগুলোও তার এই বিশেষ গুণের সাক্ষ্য দেয়।
একটা সময়ে মকসুদ ভাই পরিবেশ আন্দোলনের কাজে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। আমিও তখন ক্রমশ: পরিবেশ রক্ষার কাজে নানা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি। পাহাড়, নদী, বন, বৃক্ষরাজি রক্ষা, সুন্দরবন বাঁচানো, আদিবাসীদের নিজস্ব জীবনধারা অব্যাহত রাখতে পারার সংগ্রামে সহায়তা করার আন্দোলনের পুরোভাগে নিঃশর্তভাবে মকসুদ ভাইকে পেয়েছি আমরা। এর বাইরে গিয়েও পরিবেশ রক্ষার সরকারি-বেসরকারি সকল উদ্যোগে যখনই মকসুদ ভাইয়ের ডাক পড়েছে, মকসুদ ভাই কোন ঝুঁকি বা প্রতিকূলতার পরোয়া না করেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।
অতিমারির এই বিপর্যয়ের দিনে মানুষের প্রয়োজনে মকসুদ ভাই সবার আগে সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সেটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। মকসুদ ভাই প্রতিটি রাজনৈতিক-সামাজিক সংকটকালে তার ক্ষুরধার লেখনির মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের- তারা বেসামরিক কি সামরিক- দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। এজন্য কারো বিরাগভাজন হতে হলেও পিছপা হন নাই।
সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংক্রান্ত লেখাও আমাদের উপহার দিয়েছেন যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর জীবন নিয়ে তার কাজ। এজন্য তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মানীয় স্বীকৃতি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন সমাজ সচেতন বিবেকবান মানুষ ছিলেন, যিনি তার মানবিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সম্মান করেছেন আজীবন এবং সেই মতে চালিত করেছেন নিজেকে। তার স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
Comments