সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জীবনশিল্পী খুশবন্ত সিং

খুশবন্ত সিং। ছবি: সংগৃহীত

জীবন আসলে খুশবন্ত সিংয়ের মতো হওয়া উচিত। ৯৯ বছরে এসে থেমেছিল তার জীবনের পথচলা। বয়সের সেঞ্চুরি হয়তো পূরণ হয়নি, কিন্তু তার মতো করে জীবনকে উপভোগ করতে পারেন কম মানুষেই।

ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক। তবে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মজা করার চমৎকার ক্ষমতাও ছিল খুশবন্ত সিংয়ের। যদিও এই হাসি-ঠাট্টা আর আনন্দের মধ্যে এক গভীরতম বিষাদ ছিল তার, তা হলো মাতৃভূমি ত্যাগ। জন্ম তার পাকিস্তানের সারগোদার হাদালিতে। দেশ ছাড়ার সময় লাহোর কোর্টের আইনজীবী ছিলেন তিনি। পাকিস্তান ছাড়ার সেই যন্ত্রণা খুশবন্ত সিং ভুলতে পারেননি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। দেশভাগ নিয়ে তার লেখাগুলো পড়লেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

খুশবন্ত সিংয়ের জন্মের পর তার দাদী নাতির নাম রেখেছিলেন খুশাল সিং। দিল্লি মডার্ন স্কুলে ভর্তির পর পাঞ্জাবি শিখ হওয়ায় ছেলেপুলেরা কেউ কেউ তার নাম নিয়ে হাসাহাসি করত। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে বড় ভাই ভগবন্তর সঙ্গে নাম মিলিয়ে খুশালের নাম পাল্টে খুশবন্ত রাখা হলো।

ছাত্র হিসেবে প্রথম জীবনে তেমন কৃতিত্ব রাখতে পারেননি খুশবন্ত সিং। লাহোর সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন তৃতীয় বিভাগে। তবে এরপরই ঘুরে দাঁড়ান। লন্ডনের কিংস কলেজে ভর্তি হন আইন পড়তে। লন্ডনের সময়টাই তার জীবন বদলে দিয়েছিল। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি পড়তে গিয়ে পেয়েছিলেন সেরা ফলাফলের পুরস্কার।

পাঞ্জাবের হাদালির এই বাড়িতেই জন্ম খুশবন্ত সিংয়ের। ছবি: সংগৃহীত

তার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল লাহোর কোর্টে আইনজীবী হিসেবে। টানা ৮ বছর কাজ করার পর দেশভাগ হয়ে গেলে ঢুকে গেলেন স্বাধীন ভারতের ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে। প্রেস অ্যাটাশে এবং পাবলিক অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন লন্ডন এবং অটোয়ার ভারতীয় দূতাবাসে। সাংবাদিকতায় খুশবন্ত সিংয়ের হাতেখড়ি হয় অল ইন্ডিয়া রেডিওর মধ্য দিয়ে। সেখান থেকে ইউনেস্কোতে ৪ বছর কাজ শেষে যোজন পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন।

এক সময় বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েট ছাড়া ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক তো দূরের কথা, সহযোগী সম্পাদক হওয়ার স্বপ্নও কেউ দেখার সাহস পেতেন না। অথচ খুশবন্ত সিং এই মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও সম্পাদনা করেছেন 'দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড' ও 'দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের' মতো প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া'। অন্য সম্পাদকরা অফিস করতেন স্যুট পরে, আর খুশবন্ত সিং পরতেন টি-শার্ট।

তিনি যে কতটা পরিশ্রমী ছিলেন তা বলা বাহুল্য। ভোর সাড়ে ৪টার সময় উঠে লিখতে বসে যেতেন। ঘুমাতে যেতেন রাত ৯টায়। সময়ের ব্যাপারে ছিলেন প্রচণ্ড সচেতন। আশির দশকে ভারতের রাষ্ট্রপতি জৈল সিং এসেছিলেন খুশবন্ত সিংয়ের বাড়িতে। ২ জন ছিলেন বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁতেই খুশবন্ত সিং জৈল সিংকে বললেন, 'আমি ৯টা নাগাদ ঘুমাব। তুমি বাড়ি যাও।' কেবল তাই নয়, একাধিকবার রাত ৮টার মধ্যে খাবার না দেওয়ায় নিমন্ত্রণ থেকে উঠে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন খুশবন্ত সিং।

গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ সবই হতো তার হাতে। সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে লেখা রম্যগুলো তার অসামান্য সৃষ্টি। দেশভাগ নিয়ে খুশবন্ত সিংয়ের লেখা 'ট্রেন টু পাকিস্তান' পড়েননি এমন মানুষ কমই বলা চলে। দেশভাগ আর তার পরের কয়েক বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়ে লেখা বইটি পড়তে গিয়ে আজও স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় প্রতিক্ষণে।

ভারতীয়দের ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য রচনার ধারাটাই বদলে দিয়েছিলেন খুশবন্ত সিং। গল্প, স্মৃতিকথা, ইতিহাস বা সম্পাদকীয়- সব ক্ষেত্রেই তিনি ব্যবহার করতেন স্বভাবজাত হাস্যরস ও কৌতুকপ্রিয় মনোভাব। ফলে লেখা হয়ে উঠত অনন্য। এই ভিন্ন মাত্রার রচনাশৈলী তার লেখাকে এক আলাদা মাত্রা দিত।

পাঞ্জাবের ইতিহাস ও পাঞ্জাব নিয়ে তার লেখা ৩টি বইয়ের কথা বলতেই হয়। এগুলো হচ্ছে 'ট্রাজেডি অফ পাঞ্জাব', 'দ্য ফল অফ দ্য পাঞ্জাব', 'রনজিৎ সিং দ্য মহারাজা অফ দ্য পাঞ্জাব'। এসব বইয়ে মোহনীয় গদ্যে পাঞ্জাবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও লোকাচার তুলে ধরেছেন খুশবন্ত সিং।  

সংবাদপত্রে খুশবন্ত সিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত কলাম ছিল 'উইথ ম্যালিস টুওয়ার্ডস ওয়ান অ্যান্ড অল'। যেটা ভারতের অনেক সংবাদপত্রে শনিবারের সম্পাদকীয় পাতায়  বছরের পর বছর ছাপা হয়েছিল। মূলত ৩টি ভাগ থাকত এতে। খুশবন্ত সিংয়ের অনন্য রচনাশৈলী আর সুখপাঠ্য বাচনভঙ্গি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা দিয়েছিল কলামটিকে। এই লেখায় খুশবন্ত সিং তুলে আনতেন সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাহিত্য থেকে ভ্রমণ পর্যন্ত।

সাহিত্যে যৌনতা তুলে আনার জন্য তার দিকে সমালোচনার তীর সবসময়ই ছিল। সাহিত্যবোদ্ধারাও বারবার তার রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ করছিলেন এই নিয়ে। বলছিলেন, 'যেহেতু আমি যৌনতা নিয়ে লিখি, মদ্যপানের পক্ষে লিখি, অনেকেই আমাকে হেয় করেন।'  

খুশবন্ত সিং নিজে ব্যক্তিগত জীবনে তেমন একটা ধর্মপ্রাণ না হলেও লিখেছিলেন ২ খণ্ডের গবেষণাভিত্তিক 'অ্যা হিস্টরি অফ দ্য শিখ'। এই বইটিকে শিখ ধর্মের অন্যতম প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন খোদ শিখ ধর্মগুরুরাও। আবার শিখ উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন আজীবন সোচ্চার। প্রকাশ্যেই তিনি বলতেন, 'ধর্মীয় মৌলবাদীরা ছাড়া আমার কোনো শত্রু নেই।'

শিখদের প্রধান তীর্থস্থান অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নির্দেশে সেনা অভিযানের বিরোধিতা করে তিনিই আবার ১৯৮৪ সালে পদ্মভূষণ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশ্য পরে তাকে পদ্মবিভূষণ খেতাব দেওয়া হয়েছিল। কট্টরপন্থীরা তাকে গালি দিত 'ইন্দিরা গান্ধীর চামচা' বলে। অথচ ইন্দিরা গান্ধী যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেন তখন সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন খুশবন্ত সিং। 

২০০৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের হাত থেকে পদ্মবিভূষণ পদক নিচ্ছেন খুশবন্ত সিং। ছবি: সংগৃহীত

এই নিয়ে এক লেখায় খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন, 'আমার কাছে যখন মনে হয়েছে জরুরি অবস্থা জারি ঠিক আছে, তখন আমি ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সমর্থন জানিয়েছি। প্রতিবাদ আপনি করতেই পারেন। মিছিল-মিটিংসহ অসংখ্য কায়দা আছে। প্রয়োজনে হরতালও দিতে পারেন। কিন্তু জনমানুষের জীবনযাত্রার উপর সহিংস হতে পারেন না। আপনার কারণে অন্য একজনের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে না। আমি তখন এজন্যই সমর্থন করেছিলাম। আবার এই সরকারই যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করল, আমি আমার আপত্তি জানালাম এবং সমর্থন প্রত্যাহার করলাম।'

মুক্তিযুদ্ধের সময় নিউইয়র্ক টাইমসে নিয়মিত বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে জনমত গঠন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন খুশবন্ত সিং। মুক্তিযুদ্ধের ১ আগস্ট খুশবন্ত সিংয়ের লেখা 'হোয়াই দে ফ্লেড পাকিস্তান অ্যান্ড ওন্ট গো ব্যাক' সাড়া ফেলেছিল গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই। এ নিবন্ধ খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন শরণার্থীদের দুর্দশা এবং নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়ে। গৃহস্থ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়ের করুণ গল্প তিনি তুলে এনেছিলেন মায়াভরা হৃদয়ে।

আদতে খুশবন্ত সিংয়ের সাংবাদিকতা ছিল সরস সাংবাদিকতা। তার লেখা প্রয়োজনে ব্যাঙ্গাত্মক হতো, হতো সরস। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিক দিক থেকে প্রচণ্ড কঠোর ছিলেন খুশবন্ত সিং। পত্রিকার বিষয়ে পত্রিকার মালিকের হস্তক্ষেপ প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ কখনোই মেনে নিতে পারতেন না। এক লেখায় তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের সময় পত্রিকার বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত নিতেন সম্পাদক আর এখন সিদ্ধান্ত নেন মালিক। অথচ তার সঙ্গে সাংবাদিকতার বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই। গোটা পত্রিকায় পড়ার মতো এখন কিছুই নেই। প্রচ্ছদেই দেখা যায় কোনো নায়িকার ছবি। এটি যে সংবাদপত্র, তাই এখন মনে হয় না। আমি কখনোই সংবাদের বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিইনি।' 

বয়স কখনোই কাবু করতে পারেনি খুশবন্ত সিংকে। ৯৫ বছর বয়সে এসেও লিখেছেন  'দ্য সানসেট ক্লাবের' মতো উপন্যাস। তার জীবনের শেষ ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর যেন তার দেহভস্ম জন্মভূমি পাঞ্জাবারের  হাদালিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার শেষ এই  ইচ্ছেটি পূরণ হয়েছিল। শৈশবে তিনি যে গাছটির নিচে খেলতেন, তারই নিচে তার দেহভস্ম সমাহিত করা হয়েছিল। সমাধির ফলকে লেখা আছে, 'একজন শিখ, একজন জ্ঞানী ও পাঞ্জাবের হাদালির একজন সন্তান। এখানেই আমার শিকড়। আমি একে লালন করেছি স্মৃতিকাতর অশ্রুতে।'

আজ কিংবদন্তী খুশবন্ত সিংয়ের জন্মদিন। খুশবন্ত সিংয়ের অনন্য রচনা শৈলী, সৃষ্টিকর্ম আর জীবনবোধ আজীবন তাকে স্মরণীয় করে রাখবে পাঠকের হৃদয়ে। 

 

তথ্যসূত্র:

Truth, Love and a Little Malice/ Khushwant Singh

Khushwant Singh's Big Book of Malice

Khushwantnama, The Lessons Of My Life/ Khushwant Singh

The way he was: Khushwant Singh's dinner date with President Giani Zail Singh/ Hindustan Times

If I find a woman attractive I say so: Khushwant Singh/ Indian Today

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Reform commission reports provide framework for new Bangladesh: Yunus

Earlier this morning, the chiefs of four reform commissions submitted their reports to the chief adviser

54m ago