লেখার সময় গল্পরা আমার সঙ্গে অবিরাম কথা বলে
চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী থেকে এসেছে জাকির তালুকদারের 'কল্পনা চাকমা ও রাজার সেফাই'। বইমেলা ও নিজের লেখা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: আপনার গল্পে যেভাবে সমাজ সংকট উঠে আসে মনে হয় আপনি প্রত্যক্ষদর্শী। লেখায় এতো আন্তরিকতা রপ্ত করলেন কীভাবে?
জাকির তালুকদার: এভাবে তো ভাবিনি। আপনার প্রশ্নটি এখন আমাকেও ভাবাচ্ছে। আসলে ছোটগল্প তো শুধু কবজির কায়দা নয়, বরং জীবন ও লেখকমনের নানারকম মোচড়ের ফলাফল।
আমার লেখার ব্যাপারে যা বলতে পারি তা হচ্ছে কোনো বানানো বা ফেনানো গল্প আমি লিখি না। সবচেয়ে বেশি যে জীবনকে চিনি, সেই জীবনটিকে গল্পে নিয়ে আসি। আমার গল্প যেন মানবজীবনের ঐক্যতানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মিলেই যেন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে, সেই চেষ্টাই করি। তাছাড়া গল্পের শুধু কেটি চরিত্র নয়, সবগুলি চরিত্রের সঙ্গেই আমি একাত্ম হই। চেষ্টা করি তাদের যে পরিস্থিতিতে যে রকম আচরণ করার কথা, সেই রকম আচরণই যেন তারা করে, যে ধরনের কথা বলার কথা যে ভাষাতে বলার কথা সেই ভাষাতেই যেন কথা বলে। যখন দেখি তেমনটি ঘটছে না, তখন আমি গল্পটি লেখা বন্ধ করে দিই। পরবর্তীতে অন্যদিন চেষ্টা করি, বারংবার চেষ্টা করি। তারপরেও যদি দেখি অর্কেষ্ট্রা মিলছে না, তখন লেখাটিকে বাদ দিয়ে দিই। তা অসমাপ্ত গল্পের তালিকায় ঠাঁই পায়। কখনো কখনো পুরোপুরি বাতিলও হয়ে যায়। আমার লেখার কায়দা বলতে এটুকুই।
দ্য ডেইলি স্টার: আপনার চরিত্ররা কি আপনার সঙ্গে পরস্পরিক কথা বলে, না লেখার পরেই তাদের সঙ্গে আলাপ শেষ?
জাকির তালুকদার : লেখার সময় গল্পরা আমার সঙ্গে অবিরাম কথা বলে, তর্ক করে, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির পালা চলে পুরোটা সময়। কখনো কখনো আমি চরিত্রকে যেদিকে নিতে চাই, সেদিকে যেতে অস্বীকার করে। অন্যপথে চলতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত এমনও দেখা যায়, যা যা ভেবে আমি গল্পটি লিখতে বসেছিলাম, চরিত্ররা গল্পটিকে একেবারে বিপরীতে নিয়ে গেছে। তখন আমি আর স্রষ্টা থাকি না। বরং চরিত্রদের কথা শুনে কীবোর্ডে চাপ দিয়ে চলি। এবং অনেকক্ষেত্রেই দেখি আমি যেভাবে গল্পটি লিখতে চেয়েছিলাম, চরিত্ররা আমাকে দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি গল্প লিখিয়ে নিয়েছে। পরে ভেবে দেখেছি, তাদের কথা শুনে আমি ভুল করিনি। জোরাজুরি করলে যা হতো, চরিত্রদের স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে গল্পটি তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে।
গল্প বা উপন্যাস লেখা শেষ করার পরেও অনেকদিন ধরেই তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলে। তাদের প্রতি আমি সুবিচার করতে পেরেছি কি না সেই প্রশ্ন নিয়ে অনেকদিন মনের ভেতর নাড়াচাড়া করতে হয়। অবশেষে একটি চূড়ান্ত রূপ দেবার পরে সমাপ্তি।
লেখাটিকে ছাপার অনুমতি দেওয়ার পরে তাদের সঙ্গে আলাপ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ততদিনে আমি আরেক লেখাতে ডুব দেই।
দ্য ডেইলি স্টার: বইমেলায় অনেকের বই বের হয়। কেবলমাত্র বইমেলা দিয়ে প্রকাশনাশিল্প কত দূর যাবে?
জাকির তালুকদার: বেশিদূর যে যাবে না, বেশিদূর যে যায়নি, তা তো এখনই দেখা যাচ্ছে। বইমেলায় যে কয়টিমাত্র ভালো বা পাঠযোগ্য বই প্রকাশিত হয়, সেগুলো আগাছা-গ্রন্থের চাপে আড়াল হয়ে যায়। ভালো বইগুলোর লেখক-প্রকাশকদের উচিত সেগুলো অন্যসময় সারাবছর ধীরে ধীরে প্রকাশ করা। তাহলে সেগুলো নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা হবে, ঘরোয়া বা অনলাইন অনুষ্ঠান হবে, পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা হবে, তাতে ভালো বইয়ের প্রচার যেমন হবে, পাঠকরাও তেমনই সারাবছর বই পড়তে এবং সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন।
দ্য ডেইলি স্টার: আমাদের লেখক প্রকাশক ও পাঠকের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিদারুণ। তার কারণ কী?
জাকির তালুকদার: আমাদের প্রকাশকরা প্রকৃত অর্থে প্রকাশক হয়ে উঠতে পারেননি। ভালো পাণ্ডুলিপির জন্য যে স্কাউটিং করতে হয়, সেকথা তারা এখনো জানেন না। তাদের উচিত সারাবছর মোটামুটি উন্নতমানের যেসব পত্রিকা বের হয়, সাহিত্য পত্রিকা বের হয়, লিটল ম্যাগাজিন বের হয়, সেগুলো স্ক্যান করে সম্ভাবনাময় নতুন লেখক-কবিদের শনাক্ত করা। সেসব না করে তারা প্রথাগত পথেই বই করে থাকেন। যান কিছু প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবির কাছে। অন্য যে নতুন লেখকরা বই করতে চান, তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। নতুন সম্ভাবনাময় লেখকদের এই কারণে হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়। এদের সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি নয়। কবিতা-গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে হয়তো বিশ বা তিরিশজন সম্ভাবনাময় থাকেন।
টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন মূলত অলেখকরা। এমন ব্যক্তির সংখ্যা হাজার হাজার। প্রকাশকদের ভাষায়- 'মুরগি লেখক'। এরা টাকার জোরে লেখক হতে চান। সেই সঙ্গে নিজেদের বইয়ের প্রচারের জন্য এমন ন্যক্কারজনক সব কাজ করেন, যা যে কোনো রুচিবান মানুষকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
অন্যদিকে প্রকৃত লেখক-কবিদের সঙ্গে প্রকাশকদের সম্পর্ক কিছুতেই পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সম্মানের জায়গা বলা যাবে না। লেখকের রয়্যালিটি নিয়েই শুধু কথা নয়, লেখককে যথাযথ সম্মান দিতে শিখেছেন এমন প্রকাশকের সংখ্যা খুব কম।
দ্য ডেইলি স্টার: কালজয়ী উপন্যাসে গল্পে রাষ্ট্র সমাজ সংকটের চিত্র থাকে। সমকালের সাহিত্যে এমন চিত্র কম আসে, সংকট এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী?
জাকির তালুকদার: সবকিছু নিখুঁতভাবে উঠে আসে, সেইসঙ্গে নান্দনিকতার পরিপূর্ণ সংশ্লেশন থাকে বলেই সেগুলো কালজয়ী উপন্যাস, কালজয়ী গল্প। তেমন গল্প-উপন্যাস কোনো দেশে কোনো ভাষাতেই বছরে বছরে লিখিত হয় না। অনেক বছর পর পর আমরা এমন ধরনের উপন্যাস বা সৃষ্টিকর্ম পাই। এমনকি যারা নোবেল পুরস্কার পান, তাঁদের সবার বই কালজয়ী হয় না। দশ-বিশ-তিরিশ বছর পরে আমরা সত্যিকারের কালজয়ী বইয়ের লেখককে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখি। আমাদের ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
আপনি সম্ভবত ন্যূনতম মানসম্মত জীবনমুখি লেখার কথা বলতে চাইছেন। সেইসঙ্গে শিল্পসম্মত লেখাও। এখন সংখ্যা খুবই কম। লেখালেখিকে নিতান্ত সৌখিন কাজ ভেবে যারা লিখতে আসেন, তাদের কাছ থেকে কোনো শিল্পমণ্ডিত লেখা আশা করাই ঠিক নয়। কারণ লেখালেখির জন্য যে জীবনভর প্রস্তুতি, অনুশীলন, সাধনা করে যেতে হয়, সেসবের কথা তারা কল্পনাতেই আনতে পারবেন না।
আগে পত্রিকার সম্পাদকরা বাছাই করে লেখা ছাপতেন। এখন তারা পাতা ভরানোর জন্য বা অনুরোধে-হুকুমে কাঁচা লেখা ছাপতে বাধ্য হন। তার মানে সাহিত্য সম্পাদকরা দুর্বল লেখার প্রবণতা বৃদ্ধি করতে অনেকটাই দায়ী। সেইসঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ফেসবুক। লেখা ছাপা যখন এত সহজ, তখন তারা কেন কষ্ট করে সমাজ নিয়ে রাষ্ট্র নিয়ে জাতি নিয়ে পড়াশোনা করতে যাবে!
তবে আমাদের দেশে অন্তত পনেরোজন সিরিয়াস গদ্যলেখক আছেন, যারা নিজেদের লেখা নিয়ে আপস করেন না। আরা নতুনদের ভেতর থেকে আরো পনেরো-কুড়িজন উঠে আসছেন। আমরা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি।
Comments