রবীন্দ্রসত্তা নির্মাণে শিলাইদহ ও কুঠিবাড়ির ভূমিকা

শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ। ছবি: সংগৃহীত

আজ পঁচিশে বৈশাখ। ১৬০ বছর আগে ঠিক এই দিনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। আজ তার ১৬১তম জন্মবার্ষিকী।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের স্থান এক বহুবর্ণময় আলোকচ্ছটার মতো; অনন্য, অসাধারণ। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবকটি ধারাই এই আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত, সমৃদ্ধ। যদিও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা নয়, তথাপি তিনিই একমাত্র লিখিয়ে যিনি একটি সমগ্র সাহিত্যকে এককভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন সবচেয়ে বেশি। এভাবে তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নিজস্ব অধ্যায় তৈরি করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যকে এক সুমহান উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে, পরিচিত করেছে বিশ্বপরিসরে। আর তিনি হয়েছেন বিশ্বকবি।

বহুমুখী প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনই ছিল সৃষ্টির আধার। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালার ভেতর দিয়ে তিনি একটি সাহিত্যের সমগ্র সত্তা নির্মাণ করেছেন। যার অনুষঙ্গ হয়েছে প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, নিসর্গ ও সমগ্র প্রাণীজগৎ।

শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত মূলত কবি হিসেবে। কবিতা ও গানেই তার প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। কবি হিসেবেই ১৯১৩ সালে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এখানেও তিনি অনন্য। কারণ রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যের আর কোনো কবি-সাহিত্যিকের ভাগ্যে এই পুরস্কার জোটেনি।

রবীন্দ্রনাথের কাব্য ছিল বহুবর্ণময়; কখনো রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনো হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনোবা দার্শনিক গম্ভীরতায়, আবার কখনো উচ্ছ্বাসে মুখরিত। যার উৎস ছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিত বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি সাহিত্য।

রবীন্দ্রকাব্যের গভীরতা ও এর সৃষ্টিশীলতা সৌকর্যের এক সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত হয় লোকসঙ্গীতের লোকজ ধারার বিচিত্র প্রভাবে। এ সময় লালন শাহসহ বাংলার বিশিষ্ট বাউল সংগীতস্রষ্টাদের সান্নিধ্যে আসেন কবি। বাউল সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে জনপ্রিয় করে তুলতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা নেন। এসব বাউল গানে উনিশ শতকের কর্তাভজাদের গানের মতো অন্তর্নিহিত দৈবসত্ত্বার অনুসন্ধান এবং ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা ছিল। শিলাইদহে অবস্থানকালে তার গীতিকবিতার জন্য একটি শব্দবন্ধ তিনি গ্রহণ করেন বাউল পদাবলি থেকে। তা হচ্ছে- মনের মানুষ। ধ্যান করেন তার জীবনদেবতার। প্রকৃতি ও মানবচরিত্রের আবেগময় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে তৈরি এই যোগসূত্রটি পরমসত্তার সঙ্গে মিলিত হয় তার কাব্যে। ভানুসিংহ নামাঙ্কিত কবিতাগুলোতেও কবি এই শৈলীর ব্যবহার ঘটান। শিলাইদহে থাকাকালেই বিষয়টির অবতারণা হয়।

ধারণা করা হয় যে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী হলো তার প্রায় আড়াই হাজার গান। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত এই গীতিগুচ্ছ বাংলার সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বলা হয় থাকে তার গান সকল প্রকার মানবিক আবেগকেই সুরবদ্ধ করেছে। সাধারণ থেকে উচ্চ- সব স্তরেই যার প্রবেশগম্যতা আছে। এটি অনন্য এবং অন্য কোনো গানের ধারায় এটি দেখা যায় না।

মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে লেখা হয়, 'বাংলায় এমন কোনো শিক্ষিত গৃহ নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বা অন্ততপক্ষে গাওয়ার চেষ্টা করা হয় না... এমনকি অশিক্ষিত গ্রামবাসীরাও তার গান গেয়ে থাকেন।'

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা' ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে' রবীন্দ্রনাথেরই রচনা। 'আমার সোনার বাংলা' রচনাটিতে কুষ্টিয়ার কৃতী মানব গগণ হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে' গানটির প্রভাব সহজেই অনুমেয়, যা রবী প্রতিভায় ভিন্নভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ 'পদ্মাপ্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ' থেকে ইন্দিরা দেবীকে একবার লিখলেন, 'পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই-যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ-সংসারে এ-যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।'

কলকাতা হয়তো কবির শিল্পিসত্তাকে অনুভব-আবিষ্কার করতে দিয়েছিল, কিন্তু সেই বৈভবপূর্ণ প্রাসাদের বাইরে শিলাইদহের গ্রামীণ নৈসর্গিক জনপদে জগত ও জীবনকে নবরূপে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করেছিলেন কবি। তার কাব্যের স্বকীয়তা আর অভিনবত্ব বেশি ধরা দিয়েছিল 'সোনার তরী'র মতো বহমানতা থেকে।

শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের আবেগের উপর তাৎপর্যপূর্ণ রেখাপাত করেছিল। 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের সূচনায় তিনি লিখেছিলেন, 'আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানিনি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খররৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারাবর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পান্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানাবর্ণের আলোছায়ার তুলি। এইখানে নির্জনসজনের নিত্যসংগম চলছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনের বিচিত্র কলরব এসে পৌঁছচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা।'

১৮৮৯ সালে ত্রিশ বছর বয়সে কবি-জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি পরিদর্শনের দায়িত্ব নিয়ে আসেন শিলাইদহের নতুন কর্মতীর্থে। তিনি কুঠিবাড়িতে বসবাসের পাশাপাশি পদ্মায় বোটে বসবাস করতেন। দীর্ঘ দশ বছর পর ১৮৯৯ সালে তিনি স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা নিয়ে বর্তমান কুঠিবাড়িতে সংসার পাতেন এবং একাদিক্রমে দুই বছর এখানে অবস্থান করেন। কর্মজীবনে রবীন্দ্রনাথ ২ দশকেরও বেশি সময় শিলাইদহে ছিলেন। অবশ্য তার এই বসবাস একটানা ছিল না। তার বসবাস ও সাহিত্য-সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে শিলাইদহ ইতিহাসখ্যাত হয়েছে। এখানে দীর্ঘ জমিদারি জীবনের পাশপাশি তার কাব্য ও সাহিত্য জীবনের কর্মকাণ্ড চলেছে সমান্তরাল গতিতে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহকে তার 'যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

শিলাইদহে বসবাস ও জমিদারি পরিচালনাকালে তিনি তার বিপুল সৃষ্টির দ্বারা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেন।

জন্মান্তরে বিশ্বাসী রবীন্দ্র বারবার ফিরতে চেয়েছেন শিলাইদহে। শিলাইদহ থেকে লিখেছেন, 'আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনও জন্মগ্রহণ করব! আর কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায়, এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর, বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকতে পাব! হয়তো আর কোনো জন্মে এমন একটি সন্ধেবেলা আর কখনও ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে-আর, কিরকম মন নিয়ে বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি, কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধ ভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপরে এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না। আমি কি ঠিক এমনি মানুষটি তখন থাকব!'

পুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতৃস্মৃতি তর্পণ করতে গিয়ে বলেছেন, 'গবেষক জীবনচরিত-লেখকেরা সঠিক খবর দিতে পারবেন, তবে সাধারণভাবে আমার ধারণা, বাবার গদ্য ও পদ্য দুরকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি।"

'সোনার তরী' থেকে 'চিত্রা', 'ক্ষণিকা', 'খেয়া', 'বলাকা' 'গল্পগুচ্ছ', 'চোখের বালি', 'গোরা', 'গীতাঞ্জলি', 'গীতিমাল্য', 'গীতালী' কিংবা 'গীতাঞ্জলী' রচনা ও অনুবাদ- এসব বাদ দিলে কোন রবীন্দ্রনাথ অবশিষ্ট থাকে? পূর্বে থাকে বয়ঃসন্ধির চঞ্চলময় চিত্তের অভিব্যক্তি, পরে থাকে স্মৃতিকাতরতা আর আসন্ন জীবনাবসানের অভিজ্ঞান-উপলব্ধি। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথই আমাদের শ্রদ্ধেয়, তবে যৌবন-প্রৌঢ়ের রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয়, বিশ্ববাসীর সম্মানিত।

শুধু কাব্যরসের ধারাতেই তিনি মশগুল ছিলেন তা নয়, এই শিলাইদহে তিনি ছিলেন একজন কর্মযোগী পুরুষও। আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, নতুন নতুন ফল-ফসলের চাষাবাদ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, স্বেচ্ছাসেবী 'কিশোর ব্রতী-বালক দল' ও 'কর্মীসঙ্ঘ' গঠন, পল্লীসমাজের সার্বিক উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, স্কুল-ক্লাব-চিকিৎসালয় নির্মাণ সাপেক্ষে আদর্শ গ্রাম তৈরি, জমিদারি শাসন সংস্কার করে মণ্ডলী প্রথা প্রবর্তন, রায়ত-চাষাদের নিয়ে সমবায় আন্দোলন, গ্রামীণ মেলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, তাঁতশিল্প প্রসারে বিদ্যালয় ও কারখানা স্থাপন, লোকসাহিত্য সংগ্রহ, লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণসহ অনেক কিছুই তিনি এখানে বসে করেছেন। এই কর্মযোগের ধারাবাহিকতাই ছিল শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা। শিল্পী যে কেবল শিল্পীই হবেন না, তারও যে সামাজিক দায়িত্ব আছে তা বহুমাত্রিকভাবে কালোত্তীর্ণ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে।

তাই বলা যায়, শিল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কর্মযোগের এই মেলবন্ধনও ঘটেছিল শিলাদহ থেকেই।

Comments

The Daily Star  | English
Public universities admission woes in Bangladesh

Public universities: Admission woes deepen for students

Admission seekers are set to face increased hassle with at least 10 public universities no longer participating in the cluster-based admission test system. They are holding entrance exams on their own.

8h ago