ভাষা প্রশ্নে প্রথম বাংলা প্রকাশনা
ইতিহাস বলে দেশভাগের সঙ্গে ভাষা আন্দোলন নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আর দেশভাগের ফলে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত, ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি জনপদ মিলে পাকিস্তান এবং মধ্যবর্তী হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে ভারতের জন্ম হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন সংস্কৃতিকর্মীদের মনে ভাষা বিষয়ক প্রশ্ন ছিল অনেক আগে থেকেই। প্রসঙ্গত সে সময় 'পূর্ব পাকিস্তানের জবান' শিরোনামে সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের একটি প্রবন্ধ ব্যাপক সাড়া জাগায়। এটি ছাপা হয়েছিল মাসিক 'মোহাম্মদী'র ১৭ বর্ষে, প্রথম সংখ্যায় (কার্তিক ১৩৫০)। প্রকাশের পরপরই প্রবন্ধটি বিদগ্ধমহলে আলোচনার জন্ম দেয়। ১৯৪৩ সালে পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের ভাষা কী হবে—এ নিয়ে ছিল নানা সংশয়, তর্ক-বিতর্ক। সেই প্রেক্ষাপটে প্রবন্ধটি লিখলেন আবুল মনসুর আহমদ।
এতে বাংলা ভাষা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত না হলে বাঙালি মুসলমানরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে কী ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে, উপস্থাপিত হয়েছে সেসবের ব্যাখ্যা-যুক্তি। গোটা প্রবন্ধে বাংলা ভাষার প্রতি প্রবন্ধকারের অনুরাগ স্পষ্ট ছিল। বস্তুত, ভাষা হিসেবে বাংলা কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটি যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন দারুনভাবে এবং তা বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলমান থাকে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হবার পর সচেতন মানুষের ভাবনা- পশ্চিমাঞ্চলে মুখের জবান কী হবে? তারপর পাকিস্তান জন্মের এক মাস পরেই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের নব-সূচনা হয়। প্রকাশ করে (১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' শীর্ষক পুস্তিকা। এই প্রকশনাটি ২০ পৃষ্ঠার। কলেবর ছোট হলেও এরই মধ্যে ছিল ভাষার প্রশ্নে ঘনায়মান বিরোধের পূর্বাভাস।
এতে ৩ জন লেখকের রচনা স্থান পায়। তারা হলেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম; শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ৩ জনের রচনায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতার পাশাপাশি বাংলাকে অবমূল্যায়ণ করার ক্ষতিকর দিকও তুলে ধরা হয়।
অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায় দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্টে তুলে ধরেন। (এক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে বাংলাকে। (দুই) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে- দুটি বাংলা ও উর্দু।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুসারে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সমর্থনযোগ্য। সেই তুলনায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি খুবই ক্ষুদ্র। তাছাড়া পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। সেই নিরিখে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি খুবই যুক্তিযুক্ত।'
আবুল কাসেম লেখার পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরদার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের আলোচনা সভা চালিয়ে যেতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিতে ১৯৪৭ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে, প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
কাজী মোতাহার হোসেন তার নিবন্ধে লিখেছিলেন, '...যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলামের ওপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। তাহলে শিগগিরিই পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে পাকিস্তানের বাঙালিদের ক্ষোভ যে একসময় জাতীয়তাবাদী চিন্তায় রূপ নেবে এবং তা যে পাকিস্তানের বিভক্তি ডেকে আনতে পারে।'
আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ''উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি 'অশিক্ষিত' ও সরকারি চাকুরির 'অযোগ্য' বনিয়া যাইবেন- ঠিক যা ঘটেছিল ব্রিটিশরা ফার্সির জায়গায় ইংরেজিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা করার পর ভারতের মুসলিম শিক্ষিত সমাজের ক্ষেত্রে। ভাষার প্রশ্নটি যে 'পাকিস্তানের এক অংশের ওপর আরেক অংশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের সহিত জড়িত' এই বোধ তখন সবার মধ্যে জন্মাইতে শুরু করিবে।'
লেখকদের ধারণা বাস্তব হয়েছে। ভাষা প্রশ্নে নানান জটিলতা দেখা দিয়েছিল। প্রসঙ্গত দেখা যায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগেরও সভাপতি। ৯ দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দেন। প্রথম সভাটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) ময়দানে। এতে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু- অন্য কোনো ভাষা নয়। স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।'
কয়েকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরও একটি ভাষণ দিলেন। সেখানেও একই কথা। বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যেকোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে- তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। এমন কথা বলার পর কয়েকজন ছাত্র 'না' 'না' বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন– এতে জিন্নাহ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তারপর তিনি ভাষণ সংক্ষেপ করে কার্জন হল ত্যাগ করেন।
তিনি হয়তো ভাবেননি যে, একসময় তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন দেশটিতে নিজের উচ্চারিত কিছু কথায় দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে। ভাষা ও অর্থনীতি বৈষম্যে সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের দেশের চরম বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজ বলে বিবেচিত হয় এবং চারদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ক্ষেপে উঠে।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলির জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।' কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবি নাকচ করে দেন।
তারপর তমুদ্দন মজলিস ও ছাত্রলীগের সদস্য শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে শুরু হয় আলাপ আলোচনা। শহর-গ্রামে চলে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তার। ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনগণের আগুন। তারপরের গল্প সবার জানা।
মোটাদাগে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' প্রকাশনাটি।
Comments