‘বাংলা একাডেমিতে যোগদান করে নিজের সাহিত্য চিন্তাকে গড়ে তুলেছি’

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলা একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, অবসরে গেছেন। সম্প্রতি তিনি নিযুক্ত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি পদে। বাংলা একাডেমি, বইমেলা, সমাজ-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি পরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন, পরবর্তীতে সভাপতি হয়ে এলেন বাংলা একাডেমিতে। প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

সেলিনা হোসেন: বাংলা একাডেমি আমার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। আজকে অনেক আনন্দিত। ১৯৭০ সালের ২ জুলাই এখানে যোগদান করি। একই সময়ে সরকারি কলেজের চাকরি হয়। অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে ইন্টারভিউ কার্ড পাই। আমাকে দেওয়া হয়েছিল সিলেট এমসি কলেজে। সেখানে বেতন ছিল ৪৫০ টাকা। আমি চিন্তা করলাম বাংলা একাডেমির চাকরি যদি হয়ে যায় তখন দেখা যাবে কোথায় যোগ দেবো। তারপর বাংলা একাডেমির চাকরি হয়ে গেলো। বাংলা একাডেমিতে যোগদান করলাম। একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে আমার বেতন ছিল ২৫০ টাকা। আমি এখানে অর্থের কথা চিন্তা করিনি।

প্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিকে আমি ধারণ করেছি। এখানে যোগদান করে নিজের সাহিত্য চিন্তাকে গড়ে তুলেছি। আমার সাধনার জায়গায় বাংলা একাডেমিতে অনেক সুযোগ পেয়েছি, লেখালেখির সুযোগ পেয়েছি। যখন কাজ ছিল না তখন আমি লিখেছি আর যখন কাজ থাকত তখন সেই কাজ সম্পাদন করেছি। এভাবেই বাংলা একাডেমি পূর্ণতা পেয়েছে আমার কাছে।

ডেইলি স্টার: আপনি কত বছর ছিলেন বাংলা একাডেমিতে?

সেলিনা হোসেন: ১৯৭০ সালের ২ জুলাই যোগ দিয়ে ২০০৪ সালে অবসর নিয়েছি। মোট ৩৪ বছর। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকায় আসি। তখন পত্রিকা দেখে আমি চাকরির জন্য আবেদন করি।

ডেইলি স্টার: জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা। যে চিন্তা বা আদর্শ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি, তা কতটা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন?

সেলিনা হোসেন: বাংলা একাডেমি সেই সব কাজগুলোই করে যাচ্ছে। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে অভিধান প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সেটা সম্পন্ন হয়েছে এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনা করেছেন। দেশের প্রতিটি জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কী ধরনের শব্দ ছিল সেগুলো অভিধানে স্থান দিয়ে বড় ক্ষেত্র তৈরি করেছেন‌। প্রজন্ম এইসব অভিধান থেকে নিজেদের ভাষা জ্ঞান তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে।

বাংলা একাডেমিতে আমি যখন ছিলাম তখন প্রথম নজরুল রচনাবলী সম্পাদনা করার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেখানে প্রধান সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তারপর আমি বিজ্ঞান বিশ্বকোষ, চরিত্রাভিধান প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করেছি।

ডেইলি স্টার: আপনার সময়ে আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলী ৩ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। তার সাহিত্য বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সেলিনা হোসেন: আবুল মনসুর আহমদের রচনা আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনার রচনা পড়ে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে তিনি কীভাবে সমাজের প্রকৃত জায়গাটি ধারণ করে স্বচ্ছ ও সুন্দর জ্ঞানের জায়গা তৈরি করেছেন। যা আমাদের মতো প্রজন্মকে বড় হয়ে উঠার জন্য সহযোগিতা দিয়েছেন তার লেখার মধ্য দিয়ে।

ডেইলি স্টার: আপনার সময়ে অনেক রচনাবলী প্রকাশ হতো। তার ধারাবাহিকতা কমে গেছে। এখনো অনেক মনীষীর রচনাবলী প্রকাশ বাকি। এর কারণ কী?

সেলিনা হোসেন: আমি যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছি বাংলা একাডেমিতে অনেকে সেভাবে করেনি। আমি যখন সংকলন উপবিভাগের দায়িত্বে ছিলাম তখন জুন মাস এলে টাকা ফেরত যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে তা হতে দিতাম না। আমার মনে হতো এ টাকা মন্ত্রণালয় ফেরত যাবে‌ কেন? মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে আমাদের লেখকরা, গবেষকরা পাবেন। এই অর্থ নিয়ে বই প্রকাশ করেন সেই প্রকাশনা সংস্থা পাবেন। তাহলে কেন এটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত যাবে? আমি এভাবে সারা বছর কাজ করতাম খুব দ্রুততার সঙ্গে। যেন জুন মাস আসার আগেই সঠিকভাবে টাকাটা ব্যবহার করা যায়। আসলে আমাদের অনেকেই তো এভাবে চিন্তা করেন না, তাই এগুলো হয়নি।

ডেইলি স্টার: বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে অনেক আগ্রহ যেমন আছে, তেমনি সমালোচনাও আছে। এই ক্ষেত্রে লেখক নির্বাচন পদ্ধতিটা কি?

সেলিনা হোসেন: পদ্ধতিটা হলো—একটা কমিটি করা হয় এবং প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জনকে নমিনেশন দেওয়ার জন্য ফর্ম পাঠানো হয়। কাকে নির্বাচিত করা যায় সেই নাম তারা নমিনেশন দেন এবং কমিটি নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন এভাবে করা হয়। তাছাড়া শিল্প-সাহিত্যের জায়গা থেকেই যোগ্যদেরকে নির্বাচন করে কমিটি। তারা যাকে নির্বাচন করবে বাংলা একাডেমি সেটা মেনে নেয়। আর বাংলা একাডেমি মানে কী? এটা তো একটা বিল্ডিং না। এখানে যারা আছেন, যারা নির্বাচিত করেন, সবাই তাদের মনোজগতের কাছাকাছি মানুষ।

ডেইলি স্টার: বইমেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমির একটা অংশ ২ থেকে ৩ মাস কাজ করে। তারা এটা না করলে বাংলা একাডেমি কী তাদের গবেষণা—উৎকর্ষ সাধনে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারত?

সেলিনা হোসেন: না, ১-২ মাস তো কোনো বিশাল সময় না। এটার সঙ্গে যুক্ত থাকতেই হবে এটা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি অংশ। মেলার সঙ্গে যারা যুক্ত থাকেন তাদের যে বিভাগ এই বিভাগের যারা দায়িত্বে থাকেন তারা করেন। কিন্তু আমি তো কখনই এমন বিভাগের দায়িত্বে থাকিনি। কাজেই আমার দায়িত্বটা আমি পালন করব না কেন, প্রত্যেকের এই ভাবে ভাবা উচিত। এটা বাংলা একাডেমির কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং এটা আমাদের একটা অনুপ্রেরণার জায়গা এবং পাঠক তৈরি করার একটি বড় আদর্শ।‌

ডেইলি স্টার: বইমেলার সঙ্গে আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি যোগ সূত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু গতবার ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা করতে পারিনি। ফেব্রুয়ারিতে মেলা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

সেলিনা হোসেন: ফেব্রুয়ারিতেই বইমেলা হোক আমি তাই চাই। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলা করা খানিকটা চ্যালেঞ্জও। তাছাড়া আমরা তো আমাদের গণমানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার একটি বড় জায়গাকে উপেক্ষা করতে পারি না।‌ এটা উপেক্ষা করা উচিত না।

ডেইলি স্টার: ২০২১ সালে করোনার মধ্যেও বইমেলা করে প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন সরকারের কাছে। এতে রাষ্ট্রের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে কী বলবেন?

সেলিনা হোসেন: পৃষ্ঠপোষকতা করলে খুবই ভালো হতো। ধীরে ধীরে এটা বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। কারণ বইমেলা আমাদের শিল্প-সাহিত্যের জগতের একটি বিশাল দিক। পৃষ্ঠপোষকতা করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুতরাং রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব গ্রহণ করতেন আমরা খুশি হতাম।

ডেইলি স্টার: অনলাইনের যুগে ই-বুক আসছে। প্রিন্ট পত্রিকা কমে যাচ্ছে, ছাপা বই কমে যাচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সেলিনা হোসেন: পাঠকের ভিন্নতা আসছে। ভিন্নতা তো আসবেই, কারণ উদ্যোগগুলো নানা ধারায় হচ্ছে। সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

ডেইলি স্টার: আপনার বই বের হয় প্রতি বছর। বইয়ের বিক্রি বেড়েছে নাকি কমেছে?

সেলিনা হোসেন: বেড়েছে। অনেক বেড়েছে। আমি আমার পাঠকদের নিয়ে খুশি।

ডেইলি স্টার: পাঠক সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা রাখে পাঠাগার। গত ১০-১৫ বছর ধরে পাঠাগারগুলো আন্দোলন করে আসছে গ্রন্থাগারিকের বেতনের জন্য। তা না করে বরং বাজেট কমেছে।

সেলিনা হোসেন: পাঠাগার শুধু পাঠক তৈরি করে না, মানুষের মনন-চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। প্রতিটি মানুষের মনন-চেতনাকে সমৃদ্ধ করার জন্য গ্রন্থাগারকে সাপোর্ট দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এভাবে আমরা সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটাও তৈরি করতে পারবো এবং বই পাঠের মধ্য দিয়ে যারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে তারা আরও তাদের চারপাশে যারা থাকেন তাদেরকেও তৈরি করতে পারবেন। সুতরাং পাঠাগারের অনুদান কম দেওয়া ঠিক নয়। বরং অনুদান দিয়ে পাঠাগারের বইকে সমৃদ্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

ডেইলি স্টার: আপনি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচনা করেছেন উপন্যাস, চিন্তা করেন সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে। সমাজ সংস্কৃতি বিবেচনায় আমরা আসলে কতটুকু এগিয়েছি?

সেলিনা হোসেন:  আমরা তো মনে হয় অনেক এগিয়েছি। এই এগোনোটা আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতকে পূর্ণতা দিয়েছে। এই পূর্ণতা দিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে ভিন্ন জায়গা তৈরি করেছি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাংলা ভাষা-ভাষী অনেক এগিয়েছি।

ডেইলি স্টার: আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে কথা উঠলে মেয়েদের পোশাক নিয়ে আঙুল তোলে সবাই। তার মানে কি মেয়েরাই পোশাকে সংস্কৃতি ধরে রাখবে। ছেলেদের নিয়ে কথা নেই কেন?

সেলিনা হোসেন:  না, এটা ঠিক না। নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেই সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। সমাজ একা কারো মাধ্যমে পরিবর্তন হবে না এটা মাথা রাখতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

'No legal bar' to Babar's release after acquittal in another 10-truck arms case

He has now been cleared in both cases filed over the high-profile incident from 2004

1h ago