অনুভবের যৎসামান্য- ৪

প্রকৃতির নির্বাচিত জীবনপ্রণালী

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

কোনো এক সুদূর অতীতে, মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে বনজঙ্গল কেটে স্থায়ী নিবাস তৈরি করেছিল, তখন কিছু বন্যপ্রাণী এবং পাখি বনের গভীরে সরে না গিয়ে মানুষের সঙ্গেই রয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণ কী, মাঝে মাঝে তাই ভাবি।

আদিমকালে মানুষের জীবন ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। প্রধানত খাদ্যের সন্ধানেই তাদের যাবতীয় অভিযাত্রা পরিচালিত হতো। স্বাভাবিকভাবেই এক জায়গায় বেশিদিন বসবাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, যেহেতু কোনো জায়গাতেই খাবারের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল না, থাকেও না। হয়তো ফসল ফলানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত তারা এক জায়গায় থাকার কথা ভাবেওনি। যাযাবর জীবনই ছিল তাদের অনিবার্য নিয়তি। আর তখন অন্যান্য পশুপাখির সঙ্গে তাদের সহবস্থান করেই চলতে হতো। তারা যেমন শিকার করতো তাদের চেয়ে দুর্বল পশু-পাখিকে, তেমনই হয়তো তারাও মাঝে-মাঝে শিকারে পরিণত হতো তাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনো প্রাণীর। কে জানে, হয়তো, এই অনিশ্চিত জীবনের অবসান ঘটাতেই তারা আবিষ্কার করেছিল ফসল ফলানোর পদ্ধতি। আর সেটি করতে হলে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় অনেক দিন বসবাস না করেও উপায় নেই। ফসল তো আর একদিনে ফলে না। রোপন করা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত কত কত কাজ- দেখাশোনা করতে হয়, যত্ন করতে হয়, মনোযোগ দিতে হয়। এত কিছু করার জন্য ওই জায়গায় বসবাস করার বিকল্প তো নেই। ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি তাঁর স্যাপিয়েন্স বইতে এরকম একটা কথা লিখেছিলেন যে, মানুষ প্রথমে কাউকে পোষ মানায়নি, বরং সে-ই পোষ মেনেছিল! কার কাছে? না, অন্য কোনো প্রাণীর কাছে নয়, পোষ মেনেছিল গমের কাছে! গম উৎপাদন করতে গিয়েই তারা স্থায়ী বসত গেড়েছিল, আর তখনই মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান হতে শুরু করেছিল।

মানুষের ব্যাপারটা তবু বোঝা যায়। অনির্দিষ্টকাল ধরে খাদ্যবস্তুর অনিশ্চয়তা আর হিংস্র প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হওয়ার শঙ্কা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই হয়তো তাদেরকে বন্য জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী আবাস তৈরি করার প্ররোচনা জুগিয়েছিল, শুরু হয়েছিল সভ্যতার নির্মাণ। কিন্তু যেসব পশুপাখি তখন বনের গভীরে চলে না গিয়ে মানুষের সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল, তাদের ব্যাপারটা কী? তারা তো ফসলের কাছে পোষ মানেনি, ফসল ফলানোর কোনো উদ্যোগও নেয়নি, তাহলে তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণ কী? বাঘ এবং বিড়াল একই গোত্রের প্রাণী, কিন্তু বাঘ আসেনি মানুষের সঙ্গে থাকতে, এসেছে বিড়াল। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলেই কি বিড়াল চলে এলো বন ছেড়ে? এ যুক্তি ঠিক ধোপে টেকে না। বিড়ালের চেয়েও দুর্বল এবং নিরীহ প্রাণী হরিণ। তারা তো আসেনি! 

শেয়াল এবং কুকুর একই গোত্রের প্রাণী, কুকুর মানুষের কাছাকাছিই থাকে, পোষও মানে, কিন্তু শেয়াল রয়ে গেছে বন্য জীবনে। গরু এবং নীল গাইয়ের কথাও ভাবা যায়। একই গোত্রের প্রাণী হয়েও নীল গাই রয়ে গেছে বনেই, গরু এসেছে মানুষের কাছাকাছি। গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, বিড়াল, কুকুর, হাঁস, মুরগী এরকম অসংখ্য প্রাণী কেন মানুষের কাছাকাছি এসেছে, কেন পোষ মেনেছে, তা ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। আবার পাখির বেলায়ও তাই। অজস্র পাখি আছে যারা মানব সমাজ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। ঈগল, চিল, শকুন প্রভৃতি পাখির কথা আমাদের চট করে মনে পড়ে যাবে এ প্রসঙ্গে। উল্টোদিকে অজস্র জাতের পাখি মানব-সমাজের সঙ্গে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সহাবস্থানের কথা ভেবেছিল। আমাদের চারপাশের বিবিধ জাতের পাখির কথা ভাবলে কি সে-কথাই মনে হয় না? 

মানুষ সভ্যতা নির্মাণ করেছে, যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যন্ত্রনির্ভর জীবনকে সানন্দে গ্রহণ করেছে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, নগর গড়ে তুলেছে, আরো কত কি! যন্ত্র ছাড়া মানব-সমাজের কথা এখন আর ভাবই যায় না। অথচ এর ঠিক পাশেই রয়ে গেছে বিবিধ পশুপাখির জীবন, যে জীবনে যন্ত্রের প্রবেশ ঘটেনি, নগরায়নের ঘটনা ঘটেনি, সভ্যতার নির্মাণযজ্ঞে অংশগ্রহণ ঘটেনি। তাদের আছে নিজস্ব জীবন-প্রণালী এবং সেটি প্রকৃতি-প্রদত্ত। খাবারের জন্য তারা ফসল ফলায় না, নিসর্গ থেকে সংগ্রহ করে; ঘরও বানায় নিসর্গের নানা আপাত-তুচ্ছ উপকরণ দিয়ে। এমনকি তাদের আছে নিজস্ব চিকিৎসা-ব্যবস্থাও। যারা পশুপাখি পোষেন তারা জানেন, মানুষের মতো ওদেরও আছে নানান অসুখ-বিসুখ। পোষা প্রাণীদের জন্য তাই ডাক্তার আছে, হাসপাতালও আছে। কিন্তু যারা পোষা নয়, তারা নিজেদের চিকিৎসা করে কীভাবে? রহস্যময় লাগে না? একটা উদাহরণ দিই, যদিও দেয়া যায় প্রচুর। খেয়াল করলে দেখবেন, বিড়ালরা ওদের অসুখ-বিসুখের সময় ঘাসজাতীয় কোনো গাছের কচি পাতা খায়। ওরা তৃণভোজী নয়, তবু ওই পাতা খায় কেন? খায়, নিজেদেরকে সারিয়ে তোলার জন্য এবং সেরে ওঠেও। শুধু তাই নয়, এই জ্ঞান তারা পৌঁছে দেয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। হাজার হাজার বছর ধরে বেড়ালরা জানে, অসুখ হলে কোন গাছের পাতা খেতে হবে! নইলে এক বিড়াল থেকে অন্য বিড়ালের কাছে তথ্যটা পৌঁছতো না। অদ্ভুত লাগে না?

এই রহস্যময় জীবনপ্রণালী প্রকৃতি আমাদের আশেপাশেই রেখে দিয়েছে। কী কারণে? প্রকৃতি আসলে কী ইঙ্গিত দেয়, কোন ইশারা দেয়, কী বোঝাতে চায়? সে কি মানুষকে বলতে চায়, এই যে দেখ, এ-ই আমার নির্বাচিত জীবন-প্রণালী? তোমরাও ওদের মতোই ছিলে কিন্তু এরকম জীবনে সন্তুষ্ট না থেকে গড়ে তুলেছ সভ্যতা। সভ্যতার উপহার  হিসেবে একদিকে ভোগ করেছ বিবিধ সুযোগ ও সুবিধা, সুখ ও আনন্দ, বিলাস ও ব্যঞ্জনা; অন্যদিকে সভ্যতাই তোমাদের উপহার দিয়েছে নানা বিকার ও যন্ত্রণা, অসুখ ও বেদনা, অস্থিরতা ও অশান্তি। অথচ দেখ, অন্য পশু ও পাখিরা কিংবা কীট ও পতঙ্গরা সভ্যতা নির্মাণ না করেই স্রেফ আমার দেওয়া জীবন-প্রণালী মেনে নিয়ে লক্ষ বছর ধরে টিকে আছে। ওদের মতো জীবন তোমরা গ্রহণ না-ই করতে পারো, কারণ তোমাদেরকে আমি উপহার দিয়েছি স্বাধীন ইচ্ছা, দিয়েছি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা, তোমরা অবশ্যই তোমাদের ইচ্ছেমতো জীবন-যাপন করতে পারো, কিন্তু আমার নির্বাচিত জীবন-প্রণালীকে অস্বীকার করো না। যদি সভ্যতার অসুখগুলোকে সারাতে চাও তাহলে নিসর্গকে সঙ্গে রাখো, বৃক্ষরাজিকে পাশে রাখো; পশুপাখি-কীটপতঙ্গকেও তোমাদের জীবনের অংশ করে নাও। সেটাই হবে তোমাদের পরিপূর্ণ জীবন। প্রকৃতি বলে নাকি এসব কথা?     

এ কথা তো মিথ্যে নয় যে, চোখ ধাঁধানো সব প্রযুক্তির আবিষ্কার ক্রমশ মানুষকে নিসর্গ-বিমুখ করে তুলেছে। সেই যে বহুকাল আগে, সভ্যতার সূচনালগ্নে, কিছু পশুপাখি বনের গভীরে সরে না গিয়ে মানুষের সঙ্গেই রয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখন তারা মানুষের তৈরি নগর থেকে বহিষ্কৃত। এখন চতুর্দিকে কেবল কংক্রিটের জঞ্জাল। আর হবেই বা না কেন? ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয় - জগৎটা কেবল মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে, মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে অন্যসব প্রাণী এবং বৃক্ষজগৎ। এরকম চিন্তা একসময় এমন দৃঢ়ভাবে আমাদের ভেতরে প্রোথিত হয়ে যায় যে, আমরা ভাবতে থাকি- আমাদের প্রয়োজনে সবকিছুই নিধনযোগ্য। অথচ বিষয়টি ঠিক তার উল্টো। 

জগৎটা যেমন মানুষের, তেমনি অন্য সব পশু-পাখি-পতঙ্গেরও, এমনকি প্রতিটি গাছেরও। এই বিশ্বপ্রকৃতিতে প্রতিটি সৃষ্টির উপযোগিতা আছে, ভারসাম্য রক্ষায় সবাই পালন করে যার যার ভূমিকা। প্রকৃতির নিয়মে তাই সবার অধিকার সমান, কারো কম বা বেশি অধিকার নেই। একটা ছোট্ট উদাহরণ থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ শতকরা প্রায় একুশ ভাগ। এই অক্সিজেন দিয়েই আমরা, মানুষেরা, শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালাই। অক্সিজেন এরচয়ে কম হলে আমাদের শ্বাসকষ্ট হতো, বেশি হলেও হতো নানারকম সমস্যা। কিন্তু এ ব্যবস্থা কি কেবল মানুষের জন্যই তৈরি? তা তো হতে পারে না। অন্য পশু-পাখিরাও তো এই আবহাওয়ামণ্ডলের মধ্যেই বসবাস করে এবং তাদের জন্যও নির্ধারিত অক্সিজেনের পরিমাণ একই। তার মানে, প্রকৃতি কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়নি, কাউকে বঞ্চিতও করেনি। সবার জন্য তার একই নিয়ম, একই মমতা। এই কথাটি আমাদের মনে থাকে না বলেই আমরা প্রাণীদের প্রতি এত নির্দয় আচরণ করতে পারি, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনও করতে পারি।

আমাদের শহর থেকে গাছগুলোকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি আমরা। গাছপালা নেই বলে পাখিও নেই শহরে, অন্য প্রাণী থাকার সুযোগই নেই। অথচ তারা থাকতেই পারতো। তাদেরকে রেখেই নগরায়ন করা যেত, তাতে নগরের রূপ-সৌন্দর্য আর প্রাণ-বৈচিত্র্য বেড়ে যেত শতগুণ। বৃক্ষরাজি আর পশুপাখি নিয়ে আমাদের যে পরিপূর্ণ জীবন হবার কথা ছিল তা ত্যাগ করার ফলাফল আমরা ভোগ করছি এখন। শহর-নগরের মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে কেবল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, বিষাদ আর  বিষন্নতা; হাসি মুছে গেছে  সবার মুখ থেকে, মুছে গেছে স্বস্তির চিহ্ন। অথচ এমন কোনো জায়গায় যদি যান যেখানে সবুজ আছে, জলাভূমি আছে, পাখি ও পতঙ্গ আছে, পশুপ্রাণী আছে, দেখবেন সেখানে মানুষের মুখে হাসিও আছে, আছে আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর স্বস্তির চিহ্ন। বেশি দূর যেতেও হবে না। কাছাকাছি কোনো গ্রামে চলে যান, দেখবেন নগরের সব উপকরণই সেখানে পৌঁছেছে বটে কিন্তু নিসর্গকে তারা বর্জন করেনি। দেখবেন, পশুপাখিগুলো তাদের জীবন-যাপনেরই একটা অংশ, এমনকি গাছগুলোও, গ্রামের মানুষ ওদেরকে নিয়েই জীবন-যাপন করে, বাদ দিয়ে নয়। হয়তো সেজন্যই দুঃখ-কষ্ট, অভাব-দারিদ্র থাকলেও গ্রামে হাসিমুখের সংখ্যা শহরের তুলনায় অনেক বেশি। 

নিসর্গের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা আমাদের ভালো কিছু দেয়নি। তবু আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েই চলেছি, নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের কোনো চেষ্টাই করছি না। সময় এখনো চলে যায়নি। সভ্যতার অসুখ আমরা টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। সেই অসুখ সারাবার জন্য নিসর্গ-বিমুখতার অসুখ সারাতে হবে আগে। সভ্যতা থাকুক, সঙ্গে থাকুক নিসর্গও। থাকুক বৃক্ষরাজি-পশুপাখি আমাদেরই জীবন-যাপনের অংশ হয়ে। নিজেরা যাপন করতে না পারি, অন্তত প্রকৃতির নির্বাচিত জীবন-প্রণালীকে আমরা সম্মান জানাতে পারি ওই জীবন যারা যাপন করছে তাদেরকে আমাদের সঙ্গে রেখে, তাদেরকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে, তাদেরকে ভালোবেসে।  

 

Comments

The Daily Star  | English

Airborne superbugs lurk in Dhaka hospitals

Amid the bustling corridors of Dhaka’s hospitals, an invisible danger wafts silently through the air -- drug-resistant bacteria.

11h ago