নজরুলের নিন্দুকমহল

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের উক্তিটির মতো vini, vidi, vici এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ঝড়ের বেগে এসে বাঙালির হৃদয়ে তো বটেই, চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে নিজের একটি নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে নিলেন। 'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য'- এই শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে  শৃঙ্খলিত-নিপীড়িত বাঙালির জীবন ও সাহিত্য। 

তারপরেও স্বপ্নদ্রষ্টা মুক্তিকামী সৃজনশীল এই শিল্পীপুরুষের পথে পথে বিছানো ছিল তীব্র বেদনাদায়ক নিন্দুককাঁটা। একদিকে ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্বসমাজের কঠিন প্রতিরোধ, তথাকথিত একশ্রেণি সাহিত্যবোদ্ধাদের অবহেলা, অস্বীকৃতি, গালিগালাজ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং একইসাথে  দখলদার শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও নিষ্ঠুর রাজদণ্ড —সব মিলিয়ে নজরুলের বিকাশ ঘটে হিমালায় সমান কঠিন দুর্ভেদ্য বাধা ডিঙিয়ে।   

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব গণ-সংবর্ধনায় ধন্য। সৈনিক যখন কবি তখন তার  কবিতায় অস্ত্রের ঝংকার থাকবে, চোখে থাকবে স্বপ্ন—বিজয় ও মুক্তির স্বপ্ন। সত্য ও শক্তির পরীক্ষায় তিনি হবেন অকুতোভয়, দ্বিধাহীন। লক্ষ্য অর্জুনের ধনুর্বাণের মতো সূনির্দিষ্ট, মার খাওয়া আধ-মরা স্বজাতির মুক্তি এবং অন্তরে স্বাধীনতা বীজ বপন। তাঁর দেশ ও দেশের মানুষ ছিল বড় দুঃসময়ের মুখোমুখি। ভেতের ও বাহিরে ভাগ্যদেবতারা চালায় স্টিমরোলার। প্রতিকার নেই, প্রতিরোধও নেই। জনতার ব্যাথাতুর কণ্ঠ নীরব, নির্বাক। সৈনিক নজরুলের হাতের অস্ত্রই কলম হয়ে গেল। এ কলমেই লেখা হয় রক্ত লেখা।  'মোসলেম ভারত' পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত এক পত্রে মোহিতলাল মজুমদার জানিয়েছিলেন :

বহু কবিতা পড়িয়া  এত আনন্দ পাই নাই, এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করি নাই। বাংলা ভাষা যে এই কবির প্রাণের ভাষা হইতে পারিয়াছে, তাঁহার প্রতিভা যে সুন্দরী ও শক্তিশালিনী-এ কথায় সাহিত্য সৃষ্টিরপ্রেরণা যে তাঁহার মনোগৃহে সত্য জন্মলাভ করিয়াছে, তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ তাহার ভাব, ভাষা ও ছন্দ। আমি এ অবসরে বাংলার স্বরস্বত মণ্ডপে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি, এবং আমার বিশ্বাস প্রকৃত সাহিত্যমোদী বাঙালী পাঠক ও লেখক সাধারণের পক্ষ হইতে আমি এই সুখের কর্তব্য সম্পাদনের অগ্রসর হইয়াছি। ('মোসলেম ভারত', ভাদ্র ১৩২৭)

কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের এ লেখা নজরুলকে এনে দেয় বুনিয়াদী স্বীকৃতি। আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। মাত্র দু-বছর সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান প্রায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। নিজ জাতির বিশ্বাস ও ভরসা ক্রমশই তাঁকে আরও বেশি উদ্যোমী ও একনিষ্ঠ করে তোলে। এ কারণেই বোধহয় 'নারায়ণ' পত্রিকায় নজরুলকে ত্রিকালস্পর্শী ডাক দেবার জন্যে আহবান করে বলা হয়, জাতির মুক্তির লক্ষ্যে তিনি এমন স্বপ্ন দেখান, যেন পঙ্গুও হিমালয় অতিক্রম করতে পারে, মূক কথা বলতে পারে। 'আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।'-সুভাষচন্দ্র বসুর এমন মন্তব্যই প্রমাণ করে নজরুল জাতির মুক্তির অনিবার্য কাণ্ডারি  হয়ে উঠছেন। 'মুসলিম ভারত পত্রিকা'র সম্পাদককে লিখিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব রাধাকান্ত রায় চৌধুরী প্রত্যাশা করেন, ছন্দে-গানে কবি নজরুল যেন প্রাণের গান বাজান।

 অন্যদিকে, 'সওগাত' (মাঘ, ১৩২৭) পত্রিকায় লেখক আবুল কালাম মোহাম্মদ সামসুদ্দীন মন্তব্য করেন, কাজী নজরুল ইসলামের হাতেই প্রবর্তিত হবে বাংলা কবিতার নতুন ধারা। তাই স্বাগত নজরুল, 'আমরা কাজী সাহেবকে সাদরে সাহিত্য আসরে অভিনন্দিত করি। তিনি কাব্যের মিথ্যা ও ভণ্ডামির পূর্ণমূর্তির উপরে কাব্যের সৌন্দর্যপূর্ণ ও সত্যমূর্তির প্রতিষ্ঠা করুন।'

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের প্রতিষ্ঠা কারো দয়া কিংবা কোন গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে নয়। লাভ-লোভ-মোহ-স্বার্থের বাহিরে ছিল তার কলম। অন্যায়-অবিচার, অসত্য ও ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ও আপোষহীন এক দার্ঢ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এই শিল্পীপুরুষ। হোক তা ধর্ম, সমাজ বা শাসকের। প্রগতিশীল উদার মানবদরদি মননশীল এই শিল্পী ধর্মীয় সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি-কুসংস্কার, কৌলিন্যবোধ তথা সর্বপ্রকার অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক কোন চিন্তা বা কর্মকে কখনই সমর্থন করেননি বা প্রশ্রয় দেননি। তার লেখায় সমহারে ঠাঁই পেয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। নজরুলই প্রথম লেখক যিনি ভারতবর্ষের   সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিষবৃক্ষের শেকড়ে নির্মোহভাবে কুঠারাঘাত হানেন; এবং লণ্ডভণ্ড করে ফেলেন রক্ষণশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হিন্দু বা মুসলামান উভয়ের স্বার্থ-বলয়। একইসাথে, আঘাত করেন মোল্লা-পুরুতের ব্যবসায়িক স্বার্থে। তার নিজের কথায়;

ধর্মের সত্যকে সওয়া যায় কিন্তু শাস্ত্র যুগে যুগে অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলেই তার বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানুষও বিদ্রোহ করেছে। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায় কিন্তু তাদের টিকিত্ব ও দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দত্ব নয়, ওটা হয়তো পন্ডিত। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লত্ব! এই দুই 'ত্ব' মার্কা চুলের গোছ নিয়ে আজ এত চুলোচুলি!

নজরুলের বিরুদ্ধে কঠিন ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তারই স্বধর্মের একশ্রেণির ধর্মান্ধরা। নজরুল বরাবরই একশ্রেণির মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ভক্ত পাঠকগোষ্ঠী পেয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের মিলন মোহনায় দাঁড়িয়ে সেতুর ভূমিকা পালনকারী এই লেখকের বিরুদ্ধবাদীদের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন এঁরাই। দুই ধর্মের যা কিছু মহান ও মানুষের জন্য কল্যাণকর এবং সর্বোপরি, দেশ ও জাতির মুক্তির প্রেরণার জন্য ব্যবহার্য সবকিছুই নজরুল তাঁর গান-কবিতা-গল্পে ব্যবহার করেন পক্ষপাতহীনভাবে। 

ভারতীয় ঐতিহ্যের এই সাবলীল ব্যবহারকে 'কোফরী কালাম' বলে মন্তব্য করেছিলেন 'ইসলাম দর্শন' পত্রিকার সম্পাদক। এ পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩২৯) মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ নামের একজন 'লোকটা মুসলমান না শয়তান' এই শিরোনামে লিখেছিলেন, 'নজরুল যথেষ্ট শক্তিশালী কবি হলেও মুসলমানদের গৌরব করার কিছুই নেই।' কারণ, 'হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ'।   

তার বিস্ময়, ' দুঃখের বিষয় অজ্ঞান যুবক এখন আপনাকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিতেছে।' নজরুলের এই সাহস আর কর্মের জন্যে একশ্রেণির মুসলমানকেই দায়ী করে তিনি। তারা নজরুলকে বাহবা দিয়ে বুকের পাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর মতে, 'খোদাদ্রোহী নরাধম নাস্তিকদিগকেও পরাজিত করেছে। লোকটা শয়তানের পূর্ণাবতার।' তাঁর আক্ষেপ, 'খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডুপাত করা হইত নিশ্চয়।' 

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নজরুল 'ইন্দ্রপতন' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।  প্রগাঢ় অনুভূতি প্রকাশের স্বার্থে, কবিতায় মহৎ ভাব আনয়নের জন্য রূপকার্থে আসে নবী প্রসঙ্গ। কা-জ্ঞানবর্জিত একশ্রেণির ধর্মানুরাগীরা তেলেবেগুনে জ্বলে  ওঠে এবং নিন্দার ঝড় তুলে চারদিকে। 'মুসলিম জগৎ' (আষাঢ়, ১৩৩২) পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে বলা হয়, 'উঃ একি স্বেচ্ছাচারিতা নজরুল! তোমাকে জিজ্ঞাসা করি কোন সাহসে তুমি এ হেন অগৌরবের আল্লার নবীর উপর বাণী প্রয়োগ করিয়াছ। 

ইসলামের শোণিত বিন্দুমাত্র কি তোমার শিরায় নাই- তোমার প্রাণে কি এতটুকু ভয় নাই।' অভিশাপ করা হয়, 'নজরুল তোমার লেখনিকে অভিসম্পাত, তোমার কবি প্রতিভাকে শত সহস্র ধিক্কার।' পাশাপাশি সতর্কও করা হয়, 'আপনরারা তাহাকে সাবধান হইতে বলুন'। পরের মাসে 'মুসলিম দর্পণ' পত্রিকায় 'ইসলাম বৈরী মুসলমান কবি' শিরোনামে এক নিবন্ধে নজরুলকে গুরুতর স্বেচ্ছাচারী, ধর্মজ্ঞানহীন ও বিবেকহীন বলে অভিযুক্ত করা হয়। অভিমত প্রকাশ করা হয়, 'যথোচিত শাসিত করা সমাজের ক্ষেত্রে একটা কর্তব্য।' শেষ মন্তব্য, 'কবির ইহা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ইসলামের এইরূপ অবমাননা করিলে খোদার গজব সত্ত্বরই নাজিল হইবে।' 

নজরুলকে ঘিরে 'মোহাম্মদী বনাম সওগাত' বিতর্ক সর্বজন বিদিত। 'মোহাম্মদী' পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য ছিল নজরুল-বিরোধিতা। এ জন্যে তাদের লেখকরা মরিয়া হয়ে কলম চালিয়েছে; শিল্প-নীতি বর্জিত এসব লেখায় কখনও কখনও রুচিহীন বিকারগ্রস্ত মানসিকতারও প্রকাশ ঘটে। ধর্মরক্ষার দোহাই ছিল ওদের লেখায়। এ পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩৩৫) নজরুলের 'অগ্নিবীণা' কাব্যের বিদ্রোহীচেতনাকে ধর্মদ্রোহিতার সাথে তুলনা করে বলা হয়, 'খোদাতালার প্রতি অতি জঘন্য ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করাই তাহার এই পুস্তকের প্রধান বিশেষত্ব।' তাদের মতে, আজাজিলও এ ধরনের দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে না। এ যুবক আঘাত করেছে ইসলামের চরম ও পরম শিক্ষার মর্মমূলে। আল্লাহকে অমান্য করে বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় কালী, দুর্গা ও স্বরস্বতীর পূজা। তাঁদের সিদ্ধান্ত, 'সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এসলামের প্রধান শত্রু তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।'

নজরুল বাংলার মুসলমানদের আরাধ্য কবি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হিন্দু, বাকি অর্ধেক মুসলমান। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শক্তিশালী বাঙালি লেখক-চিন্তকের পাশাপাশি দাঁড় করানো যায় এমন একজনও মুসলমান লেখকের সন্ধান মেলে না নজরুলের আবির্ভাবের পূর্বে। মীর মশাররফ হোসেনের নাম-উচ্চারণ করা যায় বটে, কিন্তু তাঁর লেখা বাঙালির মুসলমানের সার্বিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না। 

একমাত্র নজরুলের লেখাতেই বাঙালি মুসলমানের সার্বিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। 'শাত-ইল-আরব', 'খেয়াপারের তরণী', 'মোহররম', কোরবানী প্রভৃতি এবং অসংখ্য গানে সার্থক প্রতিফলন ঘটে ইসলামি ঐতিহ্য ও চেতনার। তাই, লেখালেখির সূচনালগ্নেই নজরুল ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ফলে, খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি নিন্দুকেরা। প্রতিটি অন্যায্য ও অযৌক্তিক আক্রমণের দাঁতভাঙা প্রত্যুত্তরও জুটে বিরুদ্ধবাদীদের। বিশেষত, সওগাত দলের তরুণ লেখকরা কিছুতেই নজরুলের উপরে কোন আক্রমণকে বিনা লড়াইয়ে ছেড়ে দিতেন না। অন্যদিকে, কবির প্রতি প্রগতিশীল সুধীসমাজের আন্তরিক শ্রদ্ধার কমতি ছিল না। নজরুলের পক্ষ নিয়ে 'সওগাত' পত্রিকাটি যে দুঃসাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা বাংলা সাহিত্যে তা চিরস্মরণীয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দিয়ে 'সওগাত' পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে আছে।

অন্যদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির স্বপ্ন'।' বুদ্ধদেব বসু বলেন, 'নিন্দা করাই যাদের উদ্দেশ্য তাদের আর কোন ছল খুঁজতে হয় না। ...নইলে নজরুল ইসলামের গজল-গানগুলির প্যারোডি করতে নিশ্চয়ই তাদের হাত কাঁপতো।' (প্রগতি, চৈত্র, ১৩৩৪) 'কালিকলম' পত্রিকায় লিখেছিল, 'এ পত্রিকা (শনিবারের চিঠি) যেন বাংলার সমাজ ও সাহিত্যের আদর্শ ঠিক করে দেবার আসরে নেমেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা কলমের জোরে নয় গায়ের জোরে শক্তির পরীক্ষা দিতে হবে আগ্রহী।'

'শনিবারের চিঠি'র আক্রমণ নজরুলের জন্য বরং শাপেবর হয়েছিল। বলা যায়, নিন্দুকবাহিনীর প্রবল তৎপরতার জন্যেই নজরুলের কবিখ্যাতির এতো দ্রুত প্রসার ঘটে। একসময়, অবশ্য নিন্দুকদেরও বোধ হয়। স্বয়ং সজনীকান্ত দাসের উপলব্ধি, 'বর্তমান মানুষটিকে ভালোবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না।' একদিকে গোঁড়া মুসলমানদের আক্রমণ, অন্যদিকে নাক-উঁচা তথাকথিত বিশুদ্ধবাদী সাহিত্যিকদের আক্রমণ নজরুলকে সাময়িক সংকটের মুখে ফেলেছিল বটে, কিন্তু নজরুলের বিকাশ থেমে থাকেনি। জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুল বলেছেন :

আমার বন্ধুরা যেমন পাল্লার এধারে প্রশংসার পর প্রশংসার ফুলপাত চড়িয়েছেন, অন্য পাল্লায় অ-বন্ধুর দল তেমনি নিন্দার পর নিন্দার ধূলো-বালি কাদা-মাটি চড়িয়েছেন এবং দুই তরফের সুবিবেচনার ফলে দুই ধারের পাল্লা এমন সমভার হয়ে উঠেছে, মাঝে থেকে ঠিক থেকে গেছি, এতটুকু টলাতে পারেনি। 

সর্বোপরি নজরুল তার কালে সর্বাধিক বিতর্কিত, অবহেলিত, সংবর্ধিত ও আলোচিত কবি। সত্যের পক্ষে মানবতার জন্য প্রথাগত বা প্রতিষ্ঠিত চিন্তা বা রীতির বিপক্ষে যারাই বলেছেন বা লিখেছেন, সেই সক্রেটিসের কাল হতে আজ অবধি দণ্ডিত হতে হয়েছে। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হিমালয়সম বাঁধার প্রাচীর দাঁড়া করিয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ধার্মিক ও সাহিত্যিকরা এবং একই  সঙ্গে সরকার। কোন প্রতিবন্ধকতাই নজরুলকে আটকে রাখতে পারেনি।

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

7h ago