একজন কাজী আনোয়ার হোসেন ও অমর সৃষ্টি ‘মাসুদ রানা’
গত শতকের ষাটের দশকের মধ্য ভাগ থেকে যার যাত্রা শুরু; আশি হয়ে নব্বইয়ের দশকে এসে যা জনপ্রিয়তায় পূর্ণতা পায়। একবিংশ শতকে এসেও সে জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। সেই মাসুদ রানার জয় দশকের পর দশক ধরে। কেবল কি মাসুদ রানা? কুয়াশা থেকে রহস্যপত্রিকা; সবকিছুতেই জড়িয়ে একজন; তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন।
অথচ কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখার জগতে আসার কথাই ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করার পর রেডিওতে নিয়মিত গান গাইতেন আনোয়ার হোসেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও তাদের বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেনের তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন– সবাই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। আবার তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনও ছিলেন বেতার ও চলচ্চিত্রের নিয়মিত শিল্পী। তাই আনোয়ার হোসেনের সেই পথে হাঁটাই হয়তো গন্তব্য ছিলো। অনেকাংশে ঠিক হয়েছিলোও তাই। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীত শিল্পী । কিন্তু এরপরেই তিনি বেছে নিলেন তার বাবার পথ। রক্তে যে সাহিত্যের নেশা। পড়েছেনও বাংলা সাহিত্যে। রেডিও-টিভিতে গান গাওয়া, চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক সবই চলছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেন সংগীত ছেড়ে দেন হুট করেই। মাথায় তখন তার একটিই চিন্তা। প্রেসের ব্যবসা করবেন তিনি। বাবা কিংবদন্তী পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেনকে বলা মাত্রই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। ১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেওয়া ১০ হাজার টাকা সম্বল করে ৮ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকি টাকা দিয়ে কিনে আনলেন টাইপপত্র। মাত্র ২ জন কর্মচারীকে সঙ্গী করে শুরু হলো নতুন এক অভিযাত্রা। জন্ম নিলো সেগুনবাগান প্রকাশনীর। যা ১৯৬৪ সালের জুন মাসে কুয়াশা-১ সিরিজের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। পরবর্তীতে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই নাম পাল্টে নতুন নাম রেখেছিলেন সেবা প্রকাশনী। পরবর্তী ৬ দশকে বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশে, বিশ্ব সাহিত্যের দারুণ সব উপন্যাসের অনুবাদ ও কিশোর সাহিত্যের ধারাকে জনপ্রিয় করার জন্য এক অনন্য ভূমিকা পালন করে সেবা প্রকাশনী।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে একসময় গোয়েন্দা, কিংবা রহস্য উপন্যাস ছিল হাতেগোনা। আর সেই জায়গাটিই দখল করে নিয়েছিলো কাজী আনোয়ার হোসেনের অমর সৃষ্টি বাংলার প্রথম স্পাই থ্রিলারধর্মী সুপারহিরো চরিত্র মাসুদ রানা। মাসুদ রানা তো কেবল এক গোয়েন্দা কিংবা গুপ্তচরই নয়, বাংলার কৈশোরের এক অনিন্দ্য চরিত্র। দিনের পর দিন বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ 'মাসুদ রানা' কে ভেবে নিয়েছে এক স্বপ্নের নায়ক হিসেবে।
জনপ্রিয় চরিত্র মাসুদ রানা'র নামকরণ করা হয়েছিল ২ জন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেছিলেন। তাদের ২ জনেরই বন্ধু ছিলেন স্বনামধন্য গীতিকার মাসুদ করিম। মাসুদ করিমের নাম থেকে 'মাসুদ' আর ছেলেবেলার ইতিহাসে পড়া মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে 'রানা' নিয়ে আনোয়ার হোসেন চরিত্রের নামকরণ করেছিলেন 'মাসুদ রানা।
এই মাসুদ রানা চরিত্র সৃষ্টির ধারণা আনোয়ার হোসেন পেয়েছিলেন ১৯৬৫ সালের কোনো একদিন। তখন তিনি কুয়াশা সিরিজের জন্য নিয়মিত লিখছেন। অন্যদিনের মতো সেদিনও কুয়াশা সিরিজের জন্য লিখছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তার বন্ধু মাহবুব আমীন এসময়ে ঘরে ঢুকে বললেন, 'ওটা না লিখে আগে একটা বই পড়ো। বইটা দারুণ। মুগ্ধ হবে নিশ্চিত।' বলেই বাড়িয়ে দিলেন ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা জেমস বন্ড সিরিজের 'ডক্টর নো' বইটি। বইটি পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন, যে তিনি ঠিক করলেন বাংলা ভাষাতেই এই ধরনের একটি গোয়েন্দা চরিত্র লিখবেন। লিখবেন বললেই তো হবে না। সেজন্য চাই পড়াশোনা। আর এজন্য গোটা বাংলাবাজার তন্ন তন্ন করে বইয়ের পিছু ছুটেছেন তিনি।
তবে যে সমস্যা দেখা দিলো, তা হচ্ছে তৎকালীন বাংলাদেশে এমন ঢঙে লেখার চল ছিল না বাংলা ভাষায়। থ্রিলার ধারণ করার উপযোগী ভাষাও তিনি শিখতে লাগলেন ঠেকে ঠেকে। প্রয়োজনেই তাকে তৈরি করে নিতে হয়েছিল একটি নিজস্ব লেখার ধরন।
কেবল তাই নয়, লেখার রসদ জোগাড়ে ঘুরেছেন চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটিসহ নানা জায়গায়। একদিকে যেমন ঘুরেছেন, তেমন নিজেকে নিজে কল্পনা করেছেন বারবার। কিন্তু লেখার সময় কোনোভাবেই ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না আনোয়ার হোসেন। বারবার কাটাকাটি করে পাণ্ডুলিপির চেহারাটাই বিগড়ে গেল। তৃতীয়বার পরিষ্কার করে আবার লিখলেন গোটা কাহিনীটি। তখনো তা মনমতো হয়নি তার। ছাপার জন্য প্রেসে দিয়েছিলেন, এমনকি প্রুফ রিড করার সময়ও প্রচুর সম্পাদনা করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। টানা ৭ মাস পরিশ্রমের পর অবশেষে জন্ম নিলো 'ধ্বংস-পাহাড়'। বাংলা সাহিত্যে প্রথম স্পাইধর্মী থ্রিলার গোয়েন্দা কাহিনী 'ধ্বংস-পাহাড়' প্রথম প্রকাশিত হলো ১৯৬৬ সালের মে মাসে।
গল্পটা ছিল, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী কাপ্তাই শহরের কাছে অতিশব্দ আর অ্যান্টি গ্রেভিটি নিয়ে গবেষণারত। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই কাপ্তাই বাঁধের বিজ্ঞানী সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের শত্রু ভারতের সরবরাহ করা শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবেন বাঁধটা। আর সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানার ওপর।
'ধ্বংস পাহাড়' প্রকাশিত হওয়ার পরে আনোয়ার হোসেন নিজে এই লেখার নিয়ে সন্তুষ্ট না হলেও পাঠক কিন্তু বইটি ঠিকই লুফে নিয়েছিল। দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ধ্বংস পাহাড়। একইসঙ্গে মাসুদ রানা চরিত্রটিও। এরপর কাজী আনোয়ার হোসেন দীর্ঘ ১০ মাসের প্রস্তুতিতে লিখেন ভারত নাট্যম। এটির কাহিনী ছিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক দল এসেছে পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠান করতে। মেজর জেনারেল রাহাত খান তাদের মাঝে ঘাপলা দেখতে পেলেন। নজর রাখতে গিয়ে পিসিআইয়ের একজন এজেন্ট মারা পড়েন। এবার পাঠানো হল রানাকে। রানা কি পারবে তাদের দুরভিসন্ধি জেনে আসতে?' প্রথম বইয়ের পর মাসুদ রানা সিরিজের দ্বিতীয় বই 'ভারতনাট্যম' সাড়া ফেলেছিলো প্রবলভাবে।
এরপর একে একে জন্ম হয়েছে মাসুদ রানা সিরিজের সাড়ে চারশোরও বেশি বইয়ের। এই মাসুদ রানা সিরিজের সৃষ্টির পথও সবসময় মসৃণ ছিলো না। বেশ কয়েকবার বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। প্রথমবার এমনটা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীন হবার আগে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার মাসুদ রানা সিরিজের 'স্বর্ণমৃগ' বইটি নিষিদ্ধ করেছিল। তখন কাজী আনোয়ার হোসেন এতে চ্যালেঞ্জ করলে গোটা সিরিজই বন্ধ করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলেন ক্ষুব্ধ এক সরকারি আমলা। দ্বিতীয়বার, মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন জন টেলিফোনে হুমকি দিতে শুরু করেছিল, কেননা স্বাধীনতার আগে ভারত কেবল একটা দেশ থাকলেও যুদ্ধের সময়কার অন্যতম মিত্র দেশ ভারত। সিরিজের প্রথম দিককার বইগুলোতে ভারতকে শত্রুপক্ষ করে সাজানো কাহিনীগুলো রোষানলে পড়েছিল। তখন আনোয়ার হোসেন বাধ্য হয়ে প্রথম দিককার কয়েকটি বই থেকে ভারতবিরোধী অংশগুলো বর্জন করে নিয়েছিলেন। এমনকি ২টি বই পুণর্লিখনও করা হয়েছিল। তৃতীয়বার, প্লট সংকটের কারণে আটকে গিয়েছিল সিরিজটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোনো দেশ আর বাংলাদেশের শত্রু রইল না, অথচ শত্রুদেশ ছাড়া গুপ্তচর-কাহিনী হয় না। সেটা সামাল দেওয়ার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি খুলে গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি সিরিজটিতে গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার, ট্রেজার-হান্ট, এমনকি বিজ্ঞানকল্প ও পিশাচ কাহিনী টেনে আনা হয়েছিল। প্রতিবারই কাজী আনোয়ার হোসেন আগলে রেখেছিলেন আপন সৃষ্টিকে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের মূল নাম ছিল কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। আর ডাক নাম ছিল নবাব। ছদ্মনাম লেখার ক্ষেত্রে ছদ্মনামে তিনি নিজের নাম কখনো দিয়েছেন বিদ্যুৎ মিত্র, কখনোবা শামসুদ্দীন নওয়াব।
তবে প্রথম ২টি ছাড়া একসময় মৌলিক লেখা বাদ দিয়ে মাসুদ রানার বাকি বইগুলো বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনেই লিখেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। কিন্তু তাতেও মাসুদ রানার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে লেখা প্রসঙ্গে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, 'এর মূল কারণ, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মাসুদ রানা বইয়ে যেসব দেশের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনার কথা, জটিল পরিস্থিতির কথা থাকে, সেসব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিদেশি কাহিনির সাহায্য আমাকে নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সবকিছু আমাদের এখানে মানায়ও না।'
আমাদের কৈশোরে যেমন আমরা বুঁদ ছিলাম মাসুদ রানায়, তেমনই কাজী আনোয়ার হোসেন মুগ্ধ হয়েছিলেন হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখায়, কখনোবা রবিনহুডে।
একটি সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধায় কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, 'সেই কৈশোরে, আজ থেকে ৭৩ বছর আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা ঘটোৎকচ, যখের ধন, আবার যখের ধন, নৃমুণ্ডু শিকারী ইত্যাদি থ্রিলার বইগুলো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তার পরপরই হাতে পেলাম রবিনহুড। লেখকের নাম জানি না, সেসব খেয়াল করার বয়স ছিল না সেটা—বইটি অনেক খুঁজেও হাতে পাইনি আর। অপূর্ব লেগেছিল। রবিনের মৃত্যুতে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলাম; তার বীরত্ব, সাহস, নেতৃত্ব, বিপদগ্রস্ত ও ভাগ্যাহতদের প্রতি দুর্বলতা, গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীর প্রতি সম্মান—এই সব গুণের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এই বইগুলো আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারিনি, চির কিশোর রয়ে গেছি। আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।'
সূত্র:
কাজী আনোয়ার হোসেনের ভুবনে, শিবব্রত বর্মন ও রওশন জামিলের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো।
লেখকের মুখে মাসুদ রানা লেখার ইতিহাস, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
মাসুদ রানা: সুপার স্পাই ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিকশন, দ্য ডেইলি স্টার।
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments