মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: মীর শওকত আলী, বীর উত্তম

মীর শওকত আলী, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ষষ্ঠ পর্বে রইল মীর শওকত আলী, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে মীর শওকত আলী ছিলেন ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ৬। 

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে মীর শওকত আলীকে চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাঠানো হয়। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল জানজুয়া এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। মার্চের শুরুতে ছুটিতে ছিলেন মীর শওকত আলী। ১৫ মার্চ যখন তিনি কর্মস্থলে যোগ দিলেন তখন অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের  বাঙালি অফিসাররা তখন বুঝতে শুরু করলেন, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। 

২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেলিফোনে ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পেরে বিদ্রোহ করেন মেজর মীর শওকত আলীসহ বাঙালি অফিসাররা। প্রথমে তাদের কাছে ফোন করে খবর দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি এম এ হান্নান।  মেজর জিয়া  অফিসার্স মেসে গিয়ে মেজর মীর শওকত আলীকে বিদ্রোহ ঘোষণার কথা জানান। সঙ্গেসঙ্গেই মীর শওকত আলী বিদ্রোহে যোগ দেন। যদিও এর আগে থেকেই তারা ঘটনা আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। 

২৫ মার্চ গণহত্যার খবর পাওয়ার পর ওই রাতেই মীর শওকত আলীসহ বাঙালি অফিসাররা তাদের অধীনস্থ সব ব্যাটেলিয়ন নিজেদের দখলে নিয়ে নিলেন। তারা  দেখলেন, তাদের হাতে রাইফেল, এমএমজিসহ স্বল্পসংখ্যক কিছু অস্ত্র থাকলেও কোনো ট্যাংক বা ভারি অস্ত্র নেই। কারণ পাকিস্তানি সামরিক সরকার অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানে পাঠাবে বলে আগেই ভারি অস্ত্র, ট্যাংক ও গোলাবারুদ পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে।

মীর শওকত আলী তখন বাকিদের বললেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কারণ তারা যখন দেখবে আমরা বিদ্রোহ করেছি এবং ক্যান্টনমেন্টে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি, তখন ভারি অস্ত্র, ট্যাংক নিয়ে হামলা করবে। আমরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব না। কারণ আমাদের হাতে ট্যাংক হটানোর মতো অস্ত্র নেই। আমাদের নিরাপদ দূরত্বেই হেডকোয়ার্টার ক্যাম্প বসানো উচিত।'

এরপর তারা ২৬ মার্চ সকালেই কালুরঘাটে চলে গেলেন। সেদিন সকালে কালুরঘাটে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বাঙালি সেনারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ করবে। তবে তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হবে চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট।

১২ এপ্রিল অধীনে থাকা সেনাদের নিয়ে বান্দরবানে পৌঁছান মীর শওকত আলী। সেদিনই রাঙ্গামাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ার পর মহালছড়িতে ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার গড়ে তোলেন তিনি। ১৪ এপ্রিল লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বে আরও ২০০ সেনা মীর শওকত আলীর সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তিনি ৪টি কোম্পানিকে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট মাহফুজ ও সুবেদার মুত্তালিবের অধীনে রেখে রাঙ্গামাটির ৪ অংশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেন। ১৬ এপ্রিল মীর শওকত আলীর নির্দেশে এবং ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে ২০ সেনাকে হত্যা করে।

রাঙ্গামাটির বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছিল মীর শওকত আলীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও পরিচালনায়। এর মধ্যে ১৮ এপ্রিল চিঙ্গি নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর বহরে অতর্কিত হামলা, একই দিনে কুতুবছড়িতে ৬ ট্রাক সেনার ওপর হামলা ইত্যাদি আছে।  

কিন্তু ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়াবহ হামলায় ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলে পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যায়। ২ মে রাঙ্গামাটি, রামগড়সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের দখল হারাতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এরপর ভারতের সাবরুমে চলে যান মীর শওকত আলী।

২ মে থেকে জুন মাসের শেষ পর্যন্ত সাবরুমে বসে মেজর জিয়াসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন মীর শওকত আলী। বেশিভাগ সময়ই রাতে ঘুমানোর সময় পেতেন না তারা। মূলত রাতেই হতো অপারেশন। ২টি অপারেশনের মাঝে দিনে একটু সময় পেলে কিছুটা ঘুমিয়ে নিতেন। 

জুন মাসের শেষদিকে কর্নেল ওসমানী মীর শওকত আলীকে ডেকে বলেন, 'সিলেট এলাকায় সেক্টর খোলা হয়নি। ওই এলাকায় অনেক ইপিআর, স্বেচ্ছাসেবক ও সেনা বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তোমাকে দ্রুত শিলং যেতে হবে। সেখান থেকে যুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে।'  

এরপর মীর শওকত আলীকে ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার করা হয়। ৫ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল সিলেটের তামাবিল থেকে সুনামগঞ্জের বড়ছড়া পর্যন্ত। মীর শওকত আলী তার অধীনস্থ সেক্টরকে ৫টি সাব সেক্টরে ভাগ করেন। এই সাব সেক্টরগুলো হল ডাউকি, শেলা, ভোলাগঞ্জ, বালাট ও বড়ছড়া। মীর শওকত আলী তার সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন বাঁশতলাতে। প্রথমে তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণের ওপর জোর দেন। তাই প্রথমদিকে তিনি ভারতীয় সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের ১০ মাইল ভেতরে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ গড়ে তোলেন। এ ক্ষেত্রে বেশ সফল হোন তিনি। এক পর্যায়ে  তার নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় সুনামগঞ্জের উত্তরভাগের পুরোটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশের ভেতর বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করেন মীর শওকত আলী।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছাতক যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের ১৪ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর টানা ৫ দিনের ঐতিহাসিক ছাতক যুদ্ধের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন মীর শওকত আলী। এই যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন আরও ২৫ জন। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ২০০ সেনা এ যুদ্ধে হতাহত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্ণির যুদ্ধ অন্যতম। ওই যুদ্ধেরও পরিকল্পনা করেছিলেন মীর শওকত আলী। বর্ণিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী একের পর এক হামলা চালাচ্ছিল। সুবেদার মোশাররফ এবং এফ এফ মাহবুবের অধীনে থাকা প্লাটুন বর্ণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের শিকার হচ্ছিল। ফলে ২২ অক্টোবর মীর শওকত আলী বর্ণিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।

প্রথমে তিনি ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট তাহেরউদ্দিন আখঞ্জিকে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বর্ণিতে আক্রমণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী তাহেরউদ্দিন আখঞ্জি ২৩ অক্টোবর ভোর ৫টার দিকে বর্ণিতে পৌঁছান। আখঞ্জির উল্টো দিকে ছিল সুবেদার মোশাররফের বাহিনী। ২ দিক থেকে সমন্বিত আক্রমণের পরেও পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে প্রতিরোধ এবং পরে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী  প্রতিরোধ আর প্রচণ্ড হামলার মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তাহেরউদ্দিন আখঞ্জি ওয়ারলেসে সাহায্য চাইলে মীর শওকত আলী গোলাবারুদসহ একটি প্লাটুন পাঠান। এরপর মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিকেল ৪টার দিকে বর্ণি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সেনা নিহত হয়।

বর্ণির দখল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর গৌরিনগর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে অংশ নেন ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। এই যুদ্ধে ১২০ মিলিমিটার মর্টার নিয়ে নিজেই আক্রমণ শুরু করেন মীর শওকত আলী।  মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গৌরিনগর দখল করে নেয়। ৫ নম্বর সেক্টরের অসংখ্য যুদ্ধের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন করেছিলেন মীর শওকত আলী। 

৯ ডিসেম্বর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা গোবিন্দগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী গোবিন্দগঞ্জ ছেড়ে লামাকাজীতে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলে। এরপর মীর শওকত আলী মিত্রবাহিনীর কমান্ডার গিলের কাছে সহযোগিতা চাইলে ১২ ডিসেম্বর ৪টি ভারতীয়  বিমান পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এর ৩ দিন পরেই সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। 

মীর শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১১ জানুয়ারি পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের আগা সাদেক রোডে। মাহুতটুলি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আরমানিটোলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরে মীর শওকত আলী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন মীর শওকত আলী। তিনি চিফ অফ জেনারেল স্টাফ, ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮১ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ থেকে অবসর নেন মীর শওকত আলী। পরে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি।

২০১০ সালের ২০ নভেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মীর শওকত আলী, বীর উত্তম। 

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম ও দশম খণ্ড

বাংলাপিডিয়া 

আহমাদ ইশতিয়াক 

ahmadistiak1952@gmail.com

 

Comments

The Daily Star  | English

Sweeping changes in constitution

Expanding the fundamental rights to include food, clothing, shelter, education, internet and vote, the Constitution Reform Commission proposes to replace nationalism, socialism and secularism with equality, human dignity, social justice and pluralism as fundamental principles of state policy.

2h ago