পূর্বপুরুষের পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম
গরমের দিনে শীতলপাটিতে শুয়ে শরীর-মন জুড়ানোর প্রচলন বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কবে এ পেশার গোড়াপত্তন হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে এ অঞ্চলের পাটিকরদের মতে, এ পেশার কয়েক শ বছরের ইতিহাস আছে।
পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিখে পারিবারিকভাবেই তারা শীতলপাটি বুননের কাজ করছেন। মূলত 'পাইত্রা' নামের উদ্ভিদের বাকল দিয়ে সুনিপুণ কৌশলে তারা শীতলপাটি তৈরি করেন।
শুরুতে বরিশাল বিভাগের বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠি সদর, নলছিটি ও রাজাপুর উপজেলা এবং পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার ১২টি গ্রামে শীতলপাটি বুননের কাজ হতো। এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় ৮টি গ্রামে শীতলপাটি বুননের কাজ চলছে।
এসব গ্রামের একটি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের হাইলাকাঠি। এখানে ৮২টি পরিবারের ২৫০ নারী-পুরুষ শীতলপাটি বুননের সঙ্গে জড়িত। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে তারা পূর্বপুরুষের পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
এ পেশা সোনালী সময় হারিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ঝান্টু পাটিকর। নিজে পাটি তৈরির পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছ থেকে পাটি কিনে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করেন।
বর্তমানে একটি পাটি বিক্রি করে খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয় বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান ঝান্টু।
তিনি বলেন, 'যে পাটিকরদের নিজের পাইত্রা গাছ নেই, তাদের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। ৮০টি গাছের এক আঁটি পাইত্রা কিনতে বাগান মালিককে দিতে হয় ১৫০-৩০০ টাকা। তবে দাম নির্ভর করে গাছের মানের উপর।'
তিনি জানান, বাগান থেকে ১ আঁটি পাইত্রা সংগ্রহে শ্রমিককে দিতে হয় আরও ৪০ টাকা। এরপর গাছ থেকে বাকল আলাদা করতে গুনতে হয় আরও ৩০০ টাকা।
এ কাজ সাধারণত পুরুষরাই করে থাকেন। বটি দিয়ে বিশেষ কৌশলে পাইত্রা গাছ থেকে বাকল আলাদা করা হয়। একটি গাছ থেকে সর্বোচ্চ ১৫টি বাকল পাওয়া যায়।
এরপর নারীরা সেই বাকলের প্রতিটি থেকে আরও ৩টি বাকল আলাদা করেন যেগুলো 'বেতি' নামে পরিচিত। এর মধ্যে ২টি পাটি বুননের জন্য এবং অন্যটি পান পাতা বাঁধা কিংবা পানের বরজে পানগাছ বাঁধতে ব্যবহৃত হয়।
এর মধ্যে বাকলের পিঠের অংশের পাটি বেশি মূল্যবান। একজন নারী এক দিনে বড় মাপের একটি পাটির বেতি তুলতে পারেন।
সাধারণত একটি পাটি সর্বোচ্চ ৫ ফুট চওড়া ও ৭ ফুট লম্বা হয়। এর চেয়ে ছোট আকারের পাটিও আছে। সাধারণত একটি পাটি ৫-৭ বছর ব্যবহার করা যায়।
পাইত্রা গাছ থেকে বাকল ছাড়ানোর সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর সেগুলো এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভাতের মাড়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে তুলে ১৫ মিনিট গরম পানিতে সেদ্ধ করার পর সেগুলো রোদে শুকানো হয়।
তবে পাটি আকর্ষণীয় করতে বুকের অংশের বেতিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের রঙ দেওয়া হয়।
পাটিকরদের মতে, পাটির ভালো রঙ পাওয়ার জন্য সেগুলো ভাতের মাড়ের মধ্যে ভেজানো হয়। এ ছাড়া, এর স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য সেগুলো সেদ্ধ করা হয়।
এ সব প্রক্রিয়া শেষে শুরু হয় পাটি বুননের কাজ। সর্বোচ্চ আকারের একটি পাটি বুনতে একজন পাটিকরের ৫-৭ দিন লেগে যায়।
দ্বিতীয়বার বাকল আলাদা করা খুবই কষ্টসাধ্য বলে জানান ফুলমালা পাটিকর।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাজ করার সময় প্রায়ই হাতের আঙুল কেটে যায়। তবে সুরক্ষার জন্য হাতে কাপড় বা পলিথিন বেঁধে নিই।'
সারাদিন বসে কাজ করায় কোমর ব্যথাসহ নারীদের নানান সমস্যায় ভুগতে হয় বলে ডেইলি স্টারকে জানান রমণী বালা পাটিকর।
নিজ গোত্রের মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে হওয়ায়, শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও এ কাজ করতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না বলে জানান তিনি।
মান ও আকারভেদে প্রতিটি পাটি পাইকারি ক্রেতাদের কাছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এর চেয়ে কম দামের পাটিও আছে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা পাটি সংগ্রহ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে বিক্রি করেন।
'পাটিকররা যত্নের সঙ্গে পাটি তৈরি করেন' উল্লেখ করে তুলসি রানী পাটিকর বলেন, 'তবে এই শ্রমের মূল্য পাই না।' তিনি মনে করেন, 'পূর্বপুরুষের পেশা বলে এটি ছাড়তে পারছেন না পাটিকররা।'
লিপিকা রানী পাটিকর ডেইলি স্টারকে জানান, করোনা মহামারির সময় পাটি তৈরির কাজ বন্ধ ছিল। এখন এর প্রকোপ কমলেও, তাদের অবস্থা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
পাটিকরদের মতে, সাধারণত সচ্ছল পরিবারের লোকজনই শীতলপাটি কিনতেন। তবে বর্তমানে এয়ার কন্ডিশনারসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস পণ্য ব্যবহার করায় পাটির চাহিদা অনেক কমে গেছে।
তারা জানান, সারাবছর পাটি তৈরির কাজ চললেও, মূলত ফাল্গুন মাস থেকে এর বিক্রি শুরু হয়।
তবে টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই পেশা বদল করেছেন বলে জানান ঝুরেন চন্দ্র পাটিকর। বলেন, 'সরকার এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই এ পেশা বিলীন হয়ে যাবে।'
পাটির বাজার তৈরির মাধ্যমেই পাটিকরদের টিকে থাকা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনিসহ অন্য পাটিকররা।
Comments