আধুনিক রূপে ফিরে এলো ঐতিহ্যের ঢেঁকি

একটি ৪ হর্স পাওয়ারের মোটরের সঙ্গে ৫টি পুলি, ২টি বেল্ট এবং আরও যন্ত্রাংশের সঙ্গে যুক্ত করে বসানো হয়েছে ২টি কাঠের ঢেঁকি। ছবি: মোস্তফা সবুজ

ঢেঁকির ব্যবহার ঠিক কখন কোথায় শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও আবহমান প্রাচীন কাল থেকেই ঢেঁকি বাঙালির খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত।

প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম শস্য ছাঁটাইয়ে জন্য ঢেঁকির চল শুরু হয়েছিল। ধান ছাঁটাইয়ে, মরিচ, হলুদ, চাল ও ডাল ভানতে প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ মূলত ঢেঁকির ব্যবহার করে আসছিল। ১৫-২০ বছর আগেও প্রায় প্রতিটি গ্রামে ছিল ঢেঁকি। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সেই ঢেঁকি এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। 

প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকিকে আবার আধুনিক রূপে ফিরিয়ে এনেছেন গাইবান্ধার সদর উপজেলার খামারবোয়ালী গ্রামের যুবক শফিকুল ইসলাম। মোটর চালিত তার এই ঢেঁকি ইতোমধ্যেই সাড়া ফেলেছে গাইবান্ধা অঞ্চলে। প্রায় ৮ মাসের শ্রম এবং লক্ষাধিক টাকা খরচ করে এই প্রকল্প গ্রহণ করেছেন কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করা এই যুবক।

প্রকল্পের সামনে শফিকুল ইসলাম। ছবি: মোস্তফা সবুজ

শফিকুলের ইলেকট্রনিক ঢেঁকির দৈর্ঘ্য ৬ ফুট এবং প্রস্ত ৭ ইঞ্চি। একটি ৪ হর্স পাওয়ারের মোটরের সঙ্গে ৫টি পুলি (চাকা) ২টি বেল্ট এবং আরও যন্ত্রাংশের সঙ্গে যুক্ত করে বসানো হয়েছে ২টি কাঠের ঢেঁকি।

২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন শফিকুল। ২০২০ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। পরে নিজের এবং মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে ফিরে আসেন গ্রামে। সিদ্ধান্ত নেন মানুষকে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করবেন। গাইবান্ধার চরাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেন দেশি প্রজাতির গাইঞ্জা ধান। এই ধানের ঢেঁকি ছাঁটা চাল হয় লাল রংয়ের। যা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। কিন্তু সেই ধান প্রাচীন ঢেঁকিতে ভানতে সময় লাগে বেশি।

শফিকুল ইসলাম বলেন, 'প্রথমে আমি পায়ে চালানো ঢেঁকি দিয়েই ধান ভানা শুরু করি। কিন্তু এটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সবসময় এই কাজের জন্য লোক পাওয়া যেত না। তাছাড়া খুব কম ধান ভানা যেত। পরে অনেক চেষ্টা করে আমি এই যান্ত্রিক ঢেঁকি তৈরিতে সক্ষম হই। এতে করে এখন সময় এবং শ্রম দুই কম লাগছে। স্বল্প বিদ্যুৎ খরচে বেশি ধান ভানা যাচ্ছে। চালের দাম ও বেশ ভালো পাচ্ছি।'

এখন প্রতিদিন তার এই ঢেঁকিতে ধান ভানা হয় ৫ থেকে ৬ মণ। বছরে ধান ভানার সক্ষমতা ৮৫ টন। শফিকুল ইতোমধ্যে অনলাইনের মাধ্যমে ঢেঁকি ছাঁটা চাল পৌঁছে দিচ্ছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। দিন দিন চাহিদা অনেক বাড়ছে বলে জানান শফিকুল। চাল বিক্রি করে মাসে আয় করছেন প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

ছবি: মোস্তফা সবুজ

শফিকুল বলেন, 'ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশ থেকে অনলাইনে চালের অর্ডার পাচ্ছি। প্রকল্প সম্প্রসারণ না করলে আমি তাদের চাহিদা মিটাতে পারবো না। এ বছর আমি বেশ কিছু জমিতে জিংক সমৃদ্ধ ধান চাষ করেছি।'

শফিকুল তার ঢেঁকি দিয়ে চাল ভানার কাজের নাম দিয়েছেন এসওএ (শফিকুল, তার মা অরুণা বেগম এবং বাবা আফসার উদ্দিনের আদ্যাক্ষর) বাংলাদেশ। শফিকুল এখন স্বপ্ন দেখছেন অনেক বড় করে তুলবেন তার এই প্রকল্প। বিদেশেও তিনি রপ্তানি করতে চান ঢেঁকি ছাটা লাল চাল।

এই যুবক বলেন, 'আমার প্রজেক্টের নামের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত করেছি কারণ আমি বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে চাই। আমি যেহেতু একটি ভালো পণ্য প্রক্রিয়াজাত করছি তাই আমার চাল যেন বিদেশে গিয়েও বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারে।'

ইতোমধ্যে স্থানীয় একটি এনজিও বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য রাজী হয়েছে। গাইবান্ধার স্থানীয় একটি এনজিও ইতোমধ্যে তাকে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন এনজিওটির কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন।

মনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা শফিকুল ইসলামের ঢেঁকি ছাঁটা চালের প্রকল্পটি দেখেছি এবং এটি পুষ্টিকর লাল চাল উৎপাদনের একটি ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। যে কারণে আমরা তাকে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছি।'

শফিকুল জানান, তাকে দেখে গাইবান্ধার আরও অনেক যুবক উৎসাহিত হচ্ছেন এই ইলেকট্রনিক ঢেঁকি প্রকল্প দেওয়ার জন্য। বাড়ির পাশে ইতোমধ্যে শফিকুল ২২ শতাংশ জমির ব্যবস্থা করেছেন। যেখানে স্থাপন করবেন ৫০টি ঢেঁকি। কর্মসংস্থান হবে ২৫০ জন মানুষের।

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

2h ago