৯ নভেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ১৯ রমজান
(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজকের পর্বে রইল ১৯ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)
মুক্তিযুদ্ধে ১৯ রমজান পালিত হয়েছিল ৯ নভেম্বর। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
১৯ রমজান কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়ন ও লালমনিরহাটের বড়বাড়ি ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১১৯ জন নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধা।
এর আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল লালমনিরহাটের বড়বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিল।
রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি খোন্দকার মুখতার ইলাহীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বড়বাড়ি দখলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। সেই লক্ষ্যে দলটি বড়বাড়ি ইউনিয়নে অবস্থান নেওয়ার আগেই রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পায় পাকিস্তানি বাহিনী। ৪০০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আইরখামার গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং আক্রমণ শুরু করে।
তখন ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে হানাদাররা মুখতার ইলাহী ও এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করে। একইসঙ্গে পুরো এলাকাতেই নৃশংস গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এই গণহত্যায় গ্রামবাসীসহ মোট ১১৯ জন শহীদ হন।
৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাব সেক্টরের অধীনে ছিল সাতক্ষীরা মহকুমার কলারোয়া থানার অন্তর্গত বেলেডাঙ্গা বা মাদরা। বেলেডাঙ্গায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান। বাঙ্কার দিয়ে সুরক্ষিত এই ক্যাম্প থেকে নিয়মিত লুটপাট চালাত তারা। ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ এবং তৌফিক-ইলাহী-চৌধুরী পাকিস্তানিদের এই ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের জন্য সময় নির্ধারিত হয় ১৯ রমজান ভোর ৪টা।
ঠিক হয় মোট ১৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এই আক্রমণ হবে। এরমধ্যে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিক উল্লাহর নেতৃত্বে মূল আক্রমণকারী দলে থাকবেন ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন বাগআঁচড়ায় কাট অফ পার্টির দায়িত্বে, যেন বাগআঁচড়া থেকে কোনো পাকিস্তানি বহর সাহায্য নিয়ে বেলেডাঙ্গায় যেতে না পারে। অন্যদিকে কমান্ডার আবদুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন কলারোয়া-কোমলপুর রাস্তা বন্ধের দায়িত্বে।
১৯ রমজান আগেভাগেই সেহরি খেয়ে ভোর ৪টার দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিক উল্লাহর নেতৃত্বে মূল আক্রমণকারী দলের মুক্তিযোদ্ধারা বেলেডাঙ্গা ক্যাম্পে প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বুঝতে পারে, গোয়েন্দা ও রেকির খবর ছিল অপ্রতুল। মুক্তিবাহিনীর ধারণার দ্বিগুণ অস্ত্র গোলাবারুদ ও সেনা বেলেডাঙ্গা ক্যাম্পে।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী ভারি কামানের মাধ্যমে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এক পর্যায়ে অনবরত মেশিনগানের গুলিবর্ষণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এ সময় আহত হন ক্যাপ্টেন মাহবুব। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তখন কিছুটা কমে যায়। এ সুযোগে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। এতে ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহও আহত হন। ২ জন কমান্ডারই আহত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকাতে সুবেদার তবারক উল্লাহ একাই লড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ঘিরে ফেললেও তবারক উল্লাহ অনবরত বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন। তার গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
এই যুদ্ধে রোজা পালনরত অবস্থাতেই জাকারিয়া, এমাদুল, শফিক চৌধুরীসহ মোট ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব সেক্টরের অধীনে ছিল চুয়াডাঙ্গা মহকুমার জীবননগর থানার রাজাপুর। ১৮ রমজান বড় একটি রাজাকার দল সশস্ত্র অবস্থায় এই এলাকায় টহলের নামে লুটপাট চালাতে আসে। মুক্তিবাহিনী খবর পেয়ে রাজাকার দলটির ওপর হামলা চালায়। এ সময় রাজাকাররা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ রাজাকার নিহত হয়। ৪ রাজাকারকে রাইফেলসহ আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯ রমজান দশম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ বেড়াবাড়িয়া গ্রামে গেরিলাদের পুরনো অবস্থান পুনরুদ্ধার করেন। এদিন দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ৩টি হানাদার বিমান মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে। এ সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজন আহত হন। অন্যদিকে পরশুরামের চিথলিয়ার কাছে দশম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৫ হানাদার সেনা আটক হয়।
১৯ রমজান কুড়িগ্রামের কোম্পানি কমান্ডার সৈয়দ মনসুর আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল যাত্রাপুর বাজারে অবস্থানরত হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর ৩ সেনা ও ৯ রাজাকার নিহত হয়। পরে বাজারে থাকা ১৫০ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে কুড়িগ্রামের ঘোগাদেহ ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ রাজাকার যাত্রাপুর বাজারে এসে আত্মসমর্পণ করে। এরপর কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া বুড়াবুড়ি, মোগলবাছাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন থেকে রাজাকাররা গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের ১৯ রমজান ২ নম্বর সেক্টরের কপিতলায় মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এ সময় ঘাঁটিতে থাকা প্রায় ৬০০ হানাদার সেনার সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আরো কয়েকটি দল এসে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা নিহত এবং বহু সেনা আহত হয়। অন্যদিকে ৫ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের ১৯ রমজান মুক্তিবাহিনীর একটি দল সিলেটের কামারগাঁওয়ে ঘাঁটিতে হানাদার বাহিনীর ওপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১০ হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৯ রমজান মুক্তিবাহিনীর একটি দল ময়মনসিংহে শ্যামগঞ্জ-শম্ভুগঞ্জ এলাকায় হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার দলকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ৭ জন সেনা নিহত হয় এবং ৫ জন আহত হয়।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম এবং দশম খণ্ড
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ২, ৬, ৮
Comments