মুক্তিযুদ্ধ

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১:  ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত সত্য’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৮ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগর থেকে দেওয়া দেওয়া এক বেতার ভাষণে জাতির উদ্দেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদাররা এখন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।'

তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানতে হবে এবং বাংলাদেশের মাটিতে তাদের কবর রচনা করতে হবে। দেশ যখন আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে, তখন সে আহ্বানে যেন আমরা সাড়া দিতে পারি। আগামীকাল যেন কখনো আমাদের অপবাদ দিতে না পারে যে, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করিনি।'

একইসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব তুলেছে, তাতে বোঝাই গেছে সংঘর্ষের মূলে সে পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ বিষয়ে আমেরিকা চোখ বন্ধ করে আছে। এটা তার মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। চীন পাকিস্তানকে সবসময় বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে উসকানি দিয়েছে।'   

ভারতে এদিন

৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ। আকাশবাণী রেডিও থেকে উর্দু, হিন্দি ও পশতু ভাষায় এটি প্রচারিত হয়।

তিনি তার বক্তব্যে বলেন, 'সময় দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাকিস্তানি সেনাদের উচিত ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। বর্তমানে পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল  ও নানা বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে এসে সমবেত হচ্ছে। কিন্তু এখানেও তোমরা আশ্রয় নিতে পারবে না। শিগগির এখান থেকেও উচ্ছেদ হবে। ইতোমধ্যে তোমাদের বিমানবাহিনী অকেজো, তাদের থেকে তোমাদের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই। বহিঃবিশ্বের কোনো দেশ থেকেও তোমরা সাহায্য পাবে না। আমরা তোমাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। সমুদ্রপথেও কেউ তোমাদের কাছে রসদ সাহায্য পাঠাতে পারবে না। তোমাদের হাতে এখন প্রাণ বাঁচানো একটিই সুযোগ। সেটি হলো আত্মসমর্পণ। আর যদি আত্মসমর্পণ না করো, তবে তোমাদের ভাগ্যে রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ করো, তবে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে।'  

৮ ডিসেম্বর কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আগামী ৩ দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে আরো কয়েকদিন যুদ্ধ চলবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বিতাড়িত। আমিও জাতিসংঘ বুঝি না। আমাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী না বলা পর্যন্ত ভারতীয় সেনারা এগিয়ে যাবে। নিক্সন কিংবা ইয়াহিয়া তাদের গতিরোধ করতে পারবে না।'

৮ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের সব পাটকল, চা বাগান, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প কলকারখানা সরকারি করা হবে। এই বিষয়ে ঢাকাতে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভাও সম্প্রসারণ করা হবে। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এই মন্ত্রিসভায় থাকবেন। আগামী সপ্তাহ থেকে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হবে। সামনের সপ্তাহে জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে। শরণার্থীরা নিজ নিজ ভূমিতে শিগগির ফিরে যেতে পারবেন।'

একইসঙ্গে এটিও  জানা যায় , ফণীভূষণ মজুমদার ও আবদুল মান্নানকেও মন্ত্রী করতে পারে বাংলাদেশ সরকার। ২-৩ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যেতে পারেন।

পাকিস্তানে এদিন

৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের মনোনীত উপপ্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলাফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদানের জন্য পেশোয়ার থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। প্রতিনিধি দলে পিপিপি ও প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের নেতৃত্বে ৭ দলের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ালিশন পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা ছিলেন।

৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিকদের যুদ্ধ তহবিল খোলার আহ্বান জানান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'জনগণকে অর্থের অপচয় বন্ধ ও উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশের এই সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় সবাইকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। যে নাগরিকদের মাসিক আয় ২ হাজার টাকার বেশি, তাদের শতকরা ১০ টাকা এবং যাদের আয় তার থেকে কম, তাদেরকে শতকরা ৫ টাকা হারে প্রতিরক্ষা তহবিলে দিতে হবে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের  সাধারণ পরিষদে ভারতের  স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন,  'বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া উচিত পাকিস্তানের। জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগেই কাজ হবে না, যদি না পাকিস্তান সংঘাতের পথ পরিহার করে।'

৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ঢাকায় নিযুক্ত ২৪০ জন জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও বিদেশি নাগরিককে নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের একটি সুরক্ষিত নিরপেক্ষ অঞ্চল চেয়ে অনুরোধ জানান। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহীকে পৃথকভাবে ডেকে অনুরোধ করেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৮ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শিখ জাট ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিবাহিনীর  লেফটেন্যান্ট আইনউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলমসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি দল দুপুরের দিকে কুমিল্লা শহরে ঢোকে। এরপর হানাদার বাহিনীর কুমিল্লা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলে কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হয়। পরে এদিন বিকেলে কুমিল্লার টাউন হলে জহুর আহমেদ চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট আহমদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হওয়ার পরে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীরা জেনারেল অরোরাকে হাততালির দিয়ে স্বাগত জানান।

৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদারমুক্ত করে আশুগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ভারতীয় সেনারা আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেললাইন ও উজানিসার রোড দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে এক পর্যায়ে বিনা বাধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদার মুক্ত করে।

৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী আশুগঞ্জের পাশে আজমপুর ও দুর্গাপুরে ১১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বড় এক দল সেনা সমাবেশ করে। এ সময় সরাইল ও শাহবাজপুরের মধ্যে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত ১ ব্যাটালিয়ন সেনা পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়।

৮ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৩টি কলাম ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়। এদিন ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্রিগেড হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহের দিকে এগিয়ে যায়।

৮ ডিসেম্বর জামালপুরে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অনুরোধে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর বড় একটি দল টাঙ্গাইলে চূড়ান্ত হানাদারমুক্ত অভিযান না চালিয়েই জামালপুরের দিকে যাত্রা করে।    

৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদারমুক্ত হয়। এদিন হানাদার বাহিনী বিভিন্ন নৌযানে করে বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে যায়। এদিন দুপুর ২টার দিকে ভারতীয় বাহিনী বরিশালে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এর ১ ঘণ্টা পরে সুলতান মাস্টার এবং আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল শহর মুক্তিবাহিনীর দখলে নিয়ে নেন। পরে  সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

৮ ডিসেম্বর পিরোজপুর হানাদারমুক্ত হয়। আগের দিন সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সুন্দরবনের বিশাল এলাকা দখল করে রাত ১০টার দিকে পিরোজপুরের দক্ষিণ প্রান্তের পাড়েরহাট বন্দর দিয়ে পিরোজপুরে প্রবেশ করেন। খবর পেয়ে হানাদার বাহিনী মধ্যরাতের দিকে কচা নদী দিয়ে বরিশালের দিকে পালিয়ে যায়।

৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর নদী বন্দরের কাছে বিমান থেকে বোমা হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। বোমা হামলায় হানাদার বাহিনীর বহু নৌযান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র  পঞ্চম, ষষ্ঠ, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর, ৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার, ৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

5h ago