২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: ‘বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সাহায্য করবে ভারত’

১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ভারত সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। দেশের স্বনামধন্য প্রকৌশলী, চিকিৎসক, লেখক, বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের হত্যা করেছে।'

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডিপি ধর বলেন, 'বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে এসেছেন। তারা বাংলাদেশে কতদিন থাকবেন সেটা বাংলাদেশ সরকারই ঠিক করবেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একদিনও ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে থাকবে না।'

বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও টেলিযোগাযোগ প্রসঙ্গে ডি পি ধর বলেন, 'সড়ক, রেল ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ পাঠানো শিল্প কল-কারখানা চালু রাখা, কাঁচামাল সরবরাহকে সুনিশ্চিত করার জন্য নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে যেহেতু বাংলাদেশ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের হারিয়েছে তাই ভারত যন্ত্র প্রকৌশলীদের বাংলাদেশে প্রেরণ করে এই ঘাটতি পূরণ করার ব্যবস্থা নেবে।'

'বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এরই মধ্যে চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন সরানো শুরু হচ্ছে। শিগগির অন্যান্য বন্দরগুলোতেও এই কাজ শুরু হবে। হার্ডিঞ্জ সেতুর দ্রুত মেরামত কাজ শুরু হয়েছে।'

যুদ্ধবন্দিদের বিষয়ে ডিপি ধর বলেন, 'যুদ্ধবন্দি সম্পর্কিত বিষয়ে ভারত জেনেভা চুক্তিসহ সকল প্রকার আন্তর্জাতিক বিধি মেনে চলবে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে সামরিক যুদ্ধবন্দিদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য দায়ী বেসামরিক ব্যক্তিরা জেনেভা চুক্তির আওতায় আশ্রয় পেতে পারে না। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশ সরকারই তাদের বিচার করবেন।'

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্পর্কে ডি পি ধরকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আগ পর্যন্ত ভারত প্রচেষ্টা থামাবে না। ভারতের ফলপ্রসূ আলোচনার কারণে ব্রিটেন ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করছে।'

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর অখণ্ড পাকিস্তানের দাবি প্রসঙ্গে ডিপি ধর বলেন, 'অখণ্ড পাকিস্তানের কথা বলা এখন দিবা স্বপ্নের মতো। কয়েকটি রাষ্ট্রের প্ররোচনায় ভুট্টো এই স্বপ্ন দেখছে।'

একই সঙ্গে ভুট্টো পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সহায়তা সম্পর্কে বলেন, 'পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে। যা চরম হতাশাজনক।'

ঢাকায় এ দিন

২৬ ডিসেম্বর জাপানের প্রভাবশালী সংবাদপত্র আসাহি কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের সব দেশের সরকারের কাছে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবতা মেনে নিতে এবং স্বীকৃতি দিতে আবেদন জানান। এ সময় তিনি বলেন, 'আমি জাপানসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। আমাদের সরকারের কার্যক্রমও এখন দেশজুড়ে শুরু হয়েছে। আমরা আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আমরা উন্নত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবো। আমাদের জনগণের অসীম আত্মত্যাগই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।'

তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈনিকদের পুনর্গঠন করে তাদের জাতীয় সামরিক বাহিনীতে পরিণত করা হবে।'

মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ কবে দেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মুক্তিবাহিনীকে এখনই অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হবে না। তবে তারা যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয় তবে তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে।'

এ দিন বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে সকল দেশের সঙ্গে সহাবস্থান। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সকল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। কেউ আমাদের ওপর আক্রমণ করলে তবেই আমরা পাল্টা আক্রমণ করবো। আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে তখন আমরা পাল্টা আঘাত করতে দ্বিধা বোধ করবো না। অন্যথায় আমাদের অবস্থান হবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক।'

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরকারের বাণিজ্য দপ্তরকে মালিক ও কর্তৃপক্ষ বিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ফার্ম ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করেন।

বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. এস চক্রবর্তী নেতৃত্বে ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের একটি দল সাক্ষাৎ করেন।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থ, রাজস্ব ও বাণিজ্য মন্ত্রী এম মনসুর আলী এক ঘোষণায় বলেন, 'বাংলা ১৩৭৯ সালের ১ বৈশাখ থেকে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির ওপরে খাজনা মওকুফ হবে।'

এ দিন দুপুরে একটি ভারতীয় সামরিক উড়োজাহাজে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ। এ সময় বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আব্দুস সামাদ আজাদ। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জেনারেল মানেকশর এটিই প্রথম ঢাকা সফর।

২৬ ডিসেম্বর সাবেক পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদের পরিচালক ড. এম কায়মুদ্দিন নিজ মাসিক বেতন ২ হাজার ৬০ থেকে কমিয়ে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করেন। এ সময়ে ড. এম কায়মুদ্দিন তার বেতনের বাকি টাকা দেশের পুনর্গঠন ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ব্যয় করার ঘোষণা দেন।

ভারতে এ দিন

২৬ ডিসেম্বর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রচেষ্টা চালানো চলছে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডি নেওয়া হয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য ভুট্টো চীনা ও মার্কিন প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।'

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, '২২টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ইউরোপের দেশ।' তবে দেশগুলোর নাম এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক মহলে এ দিন

২৬ ডিসেম্বর ভয়েস অব আমেরিকার এক খবরে বলা হয়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো গৃহবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পাকিস্তান রেডিও বলেছে, সম্প্রতি রাওয়ালপিন্ডিতে তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে।

এ দিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত নিজ নিজ দেশের প্রতি আহ্বান জানান। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে পাওয়া একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে। স্থানীয় প্রাক্তন কূটনীতিক মিশনের অফিসে এরই মধ্যে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই দেশগুলো এখনো কোনো যোগাযোগ করেনি।

কাঠমুন্ডুতে পাকিস্তান দূতাবাসে নিযুক্ত প্রথম সচিব ও বাঙালি কূটনীতিবিদ একেএম মুসলেহউদ্দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

সূত্র:

দৈনিক যুগান্তর, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

এপি আর্কাইভ, এসোসিয়েটেড প্রেস, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

দ্য গার্ডিয়ান, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক, ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Students of DU, 7 colleges clash late into night

The college students began protesting in the evening and it soon led to a stand-off between them and DU students late into the night

1h ago