মুক্তিযুদ্ধ

২২ অক্টোবর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে প্রথম রোজা

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা।  মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের তৃতীয় পর্বে আজ রইল প্রথম রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধে ১ রমজান ছিল ২২ অক্টোবর। দিনটি ছিল শুক্রবার। অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এদিন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার গগণবাড়িয়া গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

এর আগে ২১ অক্টোবর সারাদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার, আল-বদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ২০০ মানুষকে গগণবাড়িয়া গ্রামে ধরে আনে। ২২ অক্টোবর প্রথম রমজানের বিকেলে গগণবাড়িয়া গ্রামের একটি মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের।

প্রথমে তাদের দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয়। এরপর ইফতারের সময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় সবাইকে। শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি হানাদার ও রাজাকাররা, গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই খুঁচিয়ে বহু মানুষের মৃত্যুও নিশ্চিত করে তারা। বাদ যায়নি শিশুরাও। এই পৈশাচিক গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ১৮৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ডের ৯০ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া যায় রাজশাহীর দুর্গাপুরের প্রত্যক্ষদর্শী সরদার আবদুল মালেকের দেওয়া গণহত্যার বর্ণনা।

তিনি বলেছেন, '১ রমজান শুক্রবার পাকিস্তানি সেনারা গগণবাড়িয়ায় অপারেশন করে। ত্রিমুখী অভিযান চালিয়ে ১১শ মতো লোককে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত করিয়ে নিয়ে তাদেরই হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ, তাদের মায়ের ওপর যখন পশুরা অত্যাচার করছিল, তখন তারা কাঁদছিল। ১০০ বছরের বেশি বয়সের অন্ধ এক বৃদ্ধকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রামে আগুন দিলে মেয়েরা যখন প্রাণভয়ে মাঠে পালায়, তখন তাদের শ্লীলতাহানি করা হয়।'

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার দেলজান বিবির উপর নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায় পবিত্র রমজানের দিনেই। তিনি বলেছেন, 'রমজান মাসে রোজা ছিলাম। বহুসংখ্যক পাকিস্তানি বর্বর সেনা আসে এবং পাশবিক অত্যাচার শুরু করে।'

পাবনার সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা হাসেম আলী তালুকদার বলেন, 'রমজান মাসের প্রথমদিকে পাবনা শহর থেকে বহু খান সেনা এসে গ্রাম ঘেরাও করে রাতের অন্ধকারে। আমার বাড়িতে আমি ও আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। খান সেনারা আমাকে ডেকে ঘর থেকে বের করে। আমাদের ২ জনকে বেদম মেরে বলে, 'তুই মুক্তিবাহিনীকে খেতে দিস। বল তারা কোথায়?' সেইসঙ্গে আমাকেসহ গ্রামের লোককে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে কয়েকজনকে হত্যা করে। স্ত্রীর অবস্থা কী, তা আর জানতে পারিনি। আমাদের কয়েকজন কড়া পাহারাদার ছিল। রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো, রোজা আবার কী জিনিস?'

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে প্রথম রমজান

প্রথম রমজানের সেহেরি করার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটিতে হামলা চালান নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও পাল্টা হামলা চালায়। এরপর উত্তরদিক থেকে লেফটেন্যান্ট আজিজ এবং সুবেদার মেজর শামসুল হকের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালালে ২ পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ২৬ জন হানাদার সেনাকে হত্যা করেন। রোজারত অবস্থাতেই শহীদ হন ৪ মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরো ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা।

প্রথম রমজানের দিন ঢাকার তেজগাঁওয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি নৌকায় অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে নৌকাটি পানিতে ডুবে যায়। এ সময় নৌকায় থাকা ৫ হানাদার সেনা গুলিতে ও পানিতে ডুবে মারা যায়। ৬ সেনা আহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের নাইকালিতে প্রথম রোজা পালনের জন্য শেষরাতে সেহেরি খাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা একসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। সেহেরি রেখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা কৌশল পাল্টে ত্রিমুখী আক্রমণ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় দেড়ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে ৩ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১৫ জন রাজাকার আহত হয়।

১ রমজান সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ৫ মাইল উত্তরে হরিসর্দার বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক বহরে হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টার এই যুদ্ধে ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। যুদ্ধ চলাকালেই ইফতার খান মুক্তিযোদ্ধারা। সেহেরিও করেন যুদ্ধের মধ্যেই।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম ও দশম খণ্ড

দৈনিক যুগান্তর, ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

3h ago