মুক্তিযুদ্ধ

১৮ নভেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘ মহাসচিবকে ইন্দিরা গান্ধীর ফিরতি চিঠি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৮ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের চিঠির জবাবে একটি ফিরতি চিঠি পাঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী উ থান্টকে বলেন, 'বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলে ভারত সবসময়ই একে স্বাগত জানাবে। ভারত চায় সেখানে যেন স্থায়ী সমাধান আসে। তবে তাতে অবশ্যই সেখানকার মানুষের মতামত থাকতে হবে। জাতিসংঘের পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর উচিত বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়া।'

এর আগে ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের অবস্থা বিষয়ে চিঠি দিয়েছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট।

১৮ নভেম্বর মুজিবনগরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। প্রায় ৬ ঘণ্টার এই বৈঠকের পর ডিপি ধর কলকাতার উদ্দেশে মুজিবনগর ত্যাগ করেন।

ভারতে এদিন

১৮ নভেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৩ লাখ ১১ হাজার টন চাল, পৌনে ২ লাখ টন গম, ৫০ হাজার টন চিনি, ১ লাখ ৮৭ হাজার টন ডাল, ৪০ হাজার টন লবণ, ৮ হাজার ৩০০ টন গুঁড়ো দুধ এবং ৪ লাখ ৩৪ হাজার কম্বল সাহায্য দেওয়ার আবেদন করে ইউরোপীয় কমন মার্কেটের কাছে।

১৮ নভেম্বর রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, 'ভারত যে কোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তবে ভারত যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কিন্তু আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত এলে আমরা ছেড়ে কথা বলব না।'

১৮ নভেম্বর দিল্লি সফররত মার্কিন বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ব্রিটিশ সরকার মনে করে, বাংলাদেশ সমস্যার দায় পাকিস্তানের এবং এর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত। ব্রিটিশ সরকার সবসময়ই আলোচনার উপর জোর দিয়েছে।'

পাকিস্তানে এদিন

১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পদত্যাগকারী বাঙালি কূটনীতিবিদ ফিলিপাইনস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে কে পন্নী, নয়াদিল্লীতে পাকিস্তানের কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও কাঠমুণ্ডুর সেকেন্ড সেক্রেটারি এ এম মুস্তাফিজুর রহমানকে চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ দেন।

১৮ নভেম্বর চীন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী লি সুই চিংয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি চীনা প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদে পৌঁছায়। ৮ দিনের সফরে এই প্রতিনিধিদলের সদস্যদের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তার অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করার কথা।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৮ নভেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য পাকিস্তান ও ভারতের নেওয়া যে কোনো উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করবে না।'

১৮ নভেম্বর সারাদিন জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সংক্রান্ত বিতর্কের পর নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আলাদা ২টি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি— এমন কথা বলে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৮ নভেম্বর ৭নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট রফিক ও লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলমপুর আমবাগানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ সময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী আলমপুর দখল করলেও লুকিয়ে থাকা হানাদার বাহিনী পেছন থেকে আক্রমণ করলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ফলে হানাদার সেনারা আলমপুর আবারও দখল করে নেয়।

১৮ নভেম্বর সকাল ৮টার দিকে পটুয়াখালীর গলাচিপার পানপট্টিতে হানাদার বাহিনীর মেজর ইয়ামিনের নেতৃত্বে ৪ কোম্পানি হানাদার সেনা মুক্তিবাহিনীর উপর হামলা করতে যায়। কিন্তু আগেই খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নুরুল হুদার নেতৃত্বে প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৬ ঘণ্টার যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে স্পিডবোটে উঠে পটুয়াখালীর দিকে পালিয়ে যায়। ৪০ জন হানাদার সেনার লাশ ফেলেই পালায় তারা।

১৮ নভেম্বর কুমিল্লার মঙ্গলপুরের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। কিছুক্ষণ পর হানাদার বাহিনী ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর ১৭ জন সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

১৮ নভেম্বর ফেনীর ফুলগাজীতে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী ফেনীর দিকে পালিয়ে গেলে ফুলগাজী সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়।

১৮ নভেম্বর কুমিল্লার কাইয়ুমপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল আরআর-এর সাহায্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ২টি বাঙ্কার ধ্বংস করে। এ সময় ১৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কর্ণফুলী চা বাগানে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এতে ৬ হানাদার সেনা আহত হয়।

১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনী ফটিকছড়ি থানা আক্রমণ করে। এ সময় থানায় থাকা হানাদার সেনা, রাজাকার ও হানাদার পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীও ত্রিমুখী হামলা চালায় এবং গেরিলাদের গুলিতে ২ হানাদার সেনা নিহত হয়। থানা থেকে মুক্তিবাহিনী ৬০টি রাইফেল, ১টি এলএমজি, ২টি স্টেনগান এবং প্রচুর গোলাবারুদ দখলে নিয়ে নেয়। একইসঙ্গে ১১ জন হানাদার পুলিশকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় মুক্তিবাহিনী।

১৮ নভেম্বর রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী রাজশাহীতে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। পরে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা আগরা পুকুর পাড়ের দিকে এলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন হানাদার সেনা ও বেশ কয়েক জন রাজাকার নিহত হয়। এ ছাড়া, ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

১৮ নভেম্বর কুষ্টিয়ার রশিপুর ঘাটে নদী পারাপার করার সময় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এ সময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। বাকি সেনারা মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী সেখান থেকে পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র সপ্তম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ১৯শে নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ১৯ ও ২০শে নভেম্বর ১৯৭১

টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৯শে নভেম্বর ১৯৭১

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
changes in Bangladesh media industry

Allegiance shifts, so do faces at the helm

Bangladesh’s media industry has seen some major shake-ups, with more than two dozen outlets shuffling leadership positions following the July mass uprising last year.

18h ago