স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধ্যায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও আপামর জনসাধারণের জন্য এক অনন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল।
রণাঙ্গন থেকে শহর, গ্রাম, বন্দর নগর সবখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেভাবে পেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
২৫ মার্চ রাতে ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস কেন্দ্রে ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল কাইয়ুম। অবস্থা বেগতিক দেখে এক সময় তিনি বাসায় চলে যান। সহকর্মী ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ তখনও ওয়্যারলেস কেন্দ্রে ছিলেন।
এ সময় আব্বাস নামের এক এক রিকশাচালক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলেন, 'এটা কী দেখেন তো!' মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ দেখেন কাগজটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লেখা। তিনি সেই রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি কোথায় পেলে এই কাগজ?' আব্বাস বললেন, 'আমি যখন মেইন রোডে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন একজন কাগজটি আমাকে দিয়ে বলেছেন, ওয়্যারলেসে চাকরি করেন এমন কাউকে দিতে।'
এদিকে অফিসে চাদর ফেলে এসেছিলেন আবদুল কাইয়ুম। ভোরের দিকে তিনি চাদর আনতে গেলে মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বললেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন।'
লেখাটি ছিল বাংলায়। কিন্তু তখন ইংরেজিতে ওয়্যারলেস বার্তা পাঠানো হতো। এরপর অনুবাদ করে সকাল ৬টার দিকে আবদুল কাইয়ুম ও মেসবাহ উদ্দিন ওয়্যারলেসের মাধ্যমে মেসেজটি চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন ওয়্যারলেস কেন্দ্রে পাঠান।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অফিসে যখন বার্তাটি পৌঁছায়, তখন সেখানে ছিলেন উত্তর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি রাখাল চন্দ্র বণিক। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদকে বিষয়টি খুলে বলেন। আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনএদের বলা হয়, পরদিন সকালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতা আখতারুজ্জামান বাবুর জুপিটার হাউসের বাসায় এ বিষয়ে বৈঠক হবে।
এরপর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। এই ঘোষণাপত্রটি বাংলায় অনুবাদ করবেন ডা. জাফর আর তা প্রথমে ঘোষণা করবেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী। তাদের সঙ্গে সেখানে যাবেন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, উত্তর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি রাখাল চন্দ্র বণিকসহ আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও সিনিয়র এমএনএরা।
এদিকে আগ্রাবাদ বেতার ভবন চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় একটা শঙ্কা ছিল। এখান থেকে ঘোষণা দেওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সহজেই আক্রমণ করতে পারবে। ফলে চট্টগ্রাম বেতারের বাঙালি কর্মকর্তারা তাদের কালুরঘাট থেকে সম্প্রচার শুরুর পরামর্শ দেন। কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রটি ছিল নগরীর চান্দগাঁওতে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অধিবেশন শুরু যেভাবে
২৬ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে এম এ হান্নান, ডা. এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, রাখাল চন্দ্র বণিক, মীর্জা আবু মনসুর প্রথম অধিবেশন চালুর লক্ষ্যে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে যান।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের দায়িত্ব নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীকে দেওয়া হলেও তিনি অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। তিনি বললেন, 'কোনো বাঙালি সামরিক অফিসারকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করালে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কারণ তাতে মানুষ বুঝবে, বাঙালি সামরিক অফিসাররাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। এতে তারা মানসিক শক্তি পাবে।'
এর আগে সকালে চট্টগ্রাম বেতারের পাণ্ডুলিপিকার বেলাল মোহাম্মদ, অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক, ফটিকছড়ি কলেজের অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ বেশ কয়েকজন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর তারা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করেন।
প্রথম অধিবেশন
এদিন দুপুর ২টায় ছাত্রনেতা রাখাল চন্দ্র বণিক কালুরঘাট থেকে বেতারে ঘোষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। একটি বিশেষ ঘোষণা। একটু পরেই জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। আপনারা যারা রেডিও খুলে বসে আছেন, তারা রেডিও বন্ধ করবেন না।'
এরপর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। তারপর ভাষণটি প্রচার করেন ডা. এম এ মান্নান। শেষ হলে জহুর আহমদ চৌধুরীর পরামর্শ মতো আওয়ামী লীগ নেতারা অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তখন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ঘোষণা দেওয়ার জন্য কালুরঘাটে যেতে রাজি হননি। তখন আওয়ামী লীগ নেতারা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দ্বিতীয় অধিবেশন
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে। আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি'র মধ্য দিয়েই শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। এরপর সমবেত কণ্ঠের গান 'জয় বাংলা বাংলার জয়' বাজানো হয়। সুলতানুল আলমের কণ্ঠে বলা হয়, 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি'। এরপর আবার সমবেত কণ্ঠে বাজে 'কারার ওই লৌহকপাট' গানটি।
গানের পর কবি আবদুস সালামের কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রচারিত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ আল ফারুকের কণ্ঠে দেওয়া হয় জরুরি ঘোষণা। এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পুনঃপাঠ করেন। পরদিন সকাল ৭টায় অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে অধিবেশন শেষ হয়।
তৃতীয় অধিবেশন
২৬ মার্চ রাত ১০টায় ফের চালু হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার। এই অধিবেশনে মাহমুদ হোসেন, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী পরদিনের অনুষ্ঠানসূচির ঘোষণা দেন।
২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন
এদিন সকালে দিনের প্রথম অধিবেশন শুরু করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র নেতারা। এই অধিবেশনে প্রথমে ভাষণ দেন ডা. এম এ মান্নান। এরপর বাংলায় সংবাদ পাঠ করেন শাহ-ই-জাহান চৌধুরী ও মাহফুজুর রহমান। ইংরেজিতে সংবাদ পাঠ করেন বেলায়েত হোসেন। দেশাত্মবোধক গানের পর সংবাদ বুলেটিন পড়েন মাহফুজুর রহমান। এরপর ভাষণ দেন আবদুল্লাহ আল হারুন। দেশাত্মবোধক গানের পর একটি প্রতিবেদন পড়েন ইউসুফ চৌধুরী।
২৭ মার্চের দ্বিতীয় অধিবেশন
২৭ মার্চ দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনের আগে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বোয়ালখালীতে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর জিয়াউর রহমানের শরণাপন্ন হন বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। সবকিছু শোনার পর মেজর জিয়াউর রহমান নিরাপত্তার জন্য তাদের সঙ্গে একটি দল পাঠান। বিকেলের মধ্যেই সেনাদলটি পুরো বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
সন্ধ্যার দিকে বেলাল মুহাম্মদের সঙ্গে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান মেজর জিয়াউর রহমান। এরপর তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর আরও ২ বার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।
২৮ মার্চ জিয়াউর রহমানের নির্দেশে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে 'বিপ্লবী' অংশটি বাদ দিয়ে এর নামকরণ করা হয় 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'।
৩০ মার্চ দুপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনী কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনের উপর বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেতার কেন্দ্রটি। তখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার ছাড়াও একটি এক কিলোওয়াটের স্বতন্ত্র ট্রান্সমিটার ছিল।
এ বিমান হামলায় কেউ হতাহত না হলেও বেতার কেন্দ্র এবং সম্প্রচার যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে সেখান থেকে সম্প্রচার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠাতা ১০ জন সদস্য ২টি দলে বিভক্ত হয়ে আগরতলা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যান। এরপর ত্রিপুরার আগরতলায় শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় অধ্যায়।
তথ্যসূত্র:
স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন/ বেগম মুশতারী শফী
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র/ বেলাল মোহাম্মদ
মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র/ তারেক মাহমুদ
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments