শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক: অন্তিম মুহূর্তেও মাথা নত করেননি যিনি
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সার্জেন্ট জহুরুল হকের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। গণঅভ্যুত্থানের মহানায়কদের অন্যতম তিনি। ১৯৬৯ সালে তাকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান পেয়েছিল চূড়ান্ত মাত্রা।
এ ঘটনার পর গণবিক্ষোভের মুখে বিনা শর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এক মাসের ব্যবধানেই পদত্যাগ করেন সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে। মামলায় তাকে করা হয়েছিল ১৭ নম্বর আসামি। তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার সম্পর্কে সরকারি প্রেস নোটে বলা হয়, 'গত মাসে (১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর) পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'
পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটির সরকারি নাম দিয়েছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার'। এই মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। প্রথমে আসামিদের 'দেশরক্ষা আইন' থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু পরে 'সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী অ্যাক্টে' সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ অন্যান্য আসামিদের পুনরায় গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। এরপর তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়।
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় বলা হয়েছিল, 'অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল।'
মামলার স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত 'সিগন্যাল অফিসার মেস' নির্ধারণ করা হয়। মামলার শেষ তারিখ ছিল ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।
এরপর ছাত্র জনতার তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, ঘটনার আগের দিন
এদিন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সেলে বন্দী। তাকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল অবাঙালি পাকিস্তানি সেনারা। তখন ষড়যন্ত্র মামলার বন্দীদের সঙ্গে প্রায়ই খারাপ আচরণ করা হতো। একইসঙ্গে চলত মানসিক নির্যাতন। দেওয়া হতো নিম্নমানের খাবার। ভাতের মধ্যে প্রায়ই কাঁকর মেশানো থাকত। এ কারণে বন্দীরা খুবই কম খেতেন। খাবার কাঁটাতারের বেড়ার পাশে জড়ো হওয়া শিশুদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন তারা। এই অতি নিম্নমানের খাবারের লোভেই ক্ষুধার্ত শিশুরা জড়ো হতো সেখানে। শিশুদের ভিড় দেখলেই পাকিস্তানি সেনারা গালি দিয়ে তাড়িয়ে দিত।
১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়ও সেলে প্রতিদিনের মতো আসামিরা খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার শেষ হওয়ার একটু আগে উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য অভুক্ত শিশুরা ভিড় জমায় কাঁটাতারের বাইরে। হঠাৎ সেলের হাবিলদার মঞ্জুর শাহ অভুক্ত শিশুদের গালাগাল করতে শুরু করেন। এসময় বন্দীরা প্রতিবাদের গলায় বলেন, 'আমরা তো আমাদের খাবার থেকে খাবার বাঁচিয়ে ওদের দিচ্ছি।' এ সময় সেলের হাবিলদার মনজুর শাহ বন্দীদের এই ব্যাপারে কথা না বলে নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ দেন।
একইসঙ্গে মঞ্জুর শাহ কয়েকজন শিশুকে ধরে এনে লাথি মারতে শুরু করেন। পুরো ব্যাপারটাই প্রথম থেকেই দেখছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। মঞ্জুর শাহের এমন দুর্ব্যবহারে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি।
তিনি কথা বলতে গেলে মনজুর শাহ রাইফেল নিয়ে জহুরুল হকের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় মঞ্জুর শাহ'র হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে জহুরুল হক বলেন, `তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে তাই এত ক্ষমতা দেখাচ্ছ। চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি।' এরপর তিনি রাইফেলটি মঞ্জুর শাহের দিকে ছুড়ে দেন। নিরস্ত্র বাঙালি আসামি এভাবে প্রতিবাদ করে রাইফেল ছুড়ে মারবেন, মঞ্জুর শাহ তা কল্পনাও করতে পারেননি। অপমানিত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বন্দীদের শিক্ষা দিতে হবে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, ঘটনার দিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে অন্য বন্দীদের সঙ্গে জহুরুল হক তার সেল থেকে বের হলে মঞ্জুর শাহ রাইফেল তাক করে তার দিকে এগিয়ে এসে বলেন, `কাল তোর সাহস দেখেছি। কিন্তু আজ আমি তোদের মেরে ফেলব।' সার্জেন্ট জহুরুল হক বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মঞ্জুর শাহর দিকে রইলেন। দেরি না করে গুলি চালালেন মঞ্জুর শাহ। গুলি লাগল সার্জেন্ট জহুরুল হকের পেটে। তিনি লুটিয়ে পড়লেন। আরেকটি গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন তার সঙ্গে বন্দী ফজলুল হকও। গুলিবিদ্ধ হয়েও ফজলুল হককে ডাকলেন জহুরুল হক। বললেন, 'ফজলু, শক্ত হও। গত রাতের সেই বর্বর সেনারা আমাদের মেরে ফেলতে চাচ্ছে। আমাদের উঠতে হবে, বাঁচতে হবে।'
এ সময় জহুরুল হকের পেটের উপর উঠে বেয়নেট নিয়ে খোঁচাতে শুরু করেন মঞ্জুর শাহ। একইসঙ্গে চলে শক্ত বুটের আঘাত। বুটের আঘাতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের কলার বোন ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত ১০টার দিকে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ডের ফলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। সার্জেন্ট জহুরুল হককে নৃশংসভাবে হত্যার খবর পাওয়ার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও সরকারি নানা কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। অতিথি ভবনে তখন ছিলেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এসএ রহমান ও প্রধান সরকারি কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদের। হামলার ঘটনায় ২ জনেই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যান। পুড়ে যায় মামলার কিছু নথিপত্র।
গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের সামরিক সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এক মাসের ব্যবধানে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠক ব্যর্থ হলে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পদত্যাগ করেন আইয়ুব খান।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর সদর উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী ছিলেন তিনি। সোনাপুর মিশনারি স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয়ে তার। পরে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে।
এ সময় তিনি যোগ দিয়েছিলেন ইউওসিটিতে। শিল্প প্রতিভাও ছিল তার। কাঠ খোদাই করে নানা রকম শিল্পকর্ম করতেন। কাঠের ছোট ছোট টুকরো সংযুক্ত আঁকতেন ছবি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তিনি যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। গ্রাউন্ড ইন্সট্রাক্টর হিসেবে তার প্রথম কর্মস্থল ছিল পাকিস্তানের কোহাটে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য বীর হিসেবে উচ্চারিত হবে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের নাম। নিরস্ত্র থাকা সত্ত্বেও যিনি পিছু হটেননি। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও ভেঙে পড়েননি। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এই অসামান্য বীরকে।
তথ্যসূত্র:
৬৯ এর শহীদ সার্জন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ/ নাজনীন হক মিমি
আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক / ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন ও নাজনীন হক মিমি
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments