রণেশ দাশগুপ্ত: মহাকালের আজন্ম বিপ্লবী
তার জীবনকে বলা যায় সংগ্রাম বা বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। যে জীবন কেবলই সংগ্রামের। বলা হয়, মানুষ জীবনের দুটি পিঠই দেখে, কিন্তু রণেশ দাশগুপ্তের জীবন মুদ্রার এক পিঠ। যার সংগ্রাম কখনো শেষ হয়নি।
যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিলো শৈশবেই, সে সংগ্রাম ছিল মৃত্যুর আগের দিন অবধি। ত্রিশের দশকের কথা। রাঁচির স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হলেন রণেশ দাশগুপ্ত। যেখানেই সংগ্রামের শুরু। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এমন সময়েই কলেজ থেকে বহিষ্কার।
বলে রাখা ভালো, রণেশ দাশগুপ্তের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন চাকরিজীবী, ফুটবলার হিসেবেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। আর কাকা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন গান্ধিবাদী এবং বিহার কংগ্রেসের সভাপতি। ফলে তাদের পরিবারটিই ছিল মোটামুটি রাজনৈতিক পরিবার। কাকার সুবাদে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রাঁচির হিন্দুপাড়ায় ছিল থিয়েটার ও ব্যায়ামাগার। সেখানে নিয়মিত যেতেন তিনি। আর ব্যায়ামাগারের প্রশিক্ষক হরিপদ দে হয়ে উঠল তার রাজনৈতিক গুরু। এখানেই বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে রণেশ দাশগুপ্তের। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন জেঠাতো ভাই বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত। এখানে একই সঙ্গে সংগঠন তৈরির হাতেখড়িও হয়েছিল তার। তরুণ সংঘ নামের এই সংগঠন গড়ার কারণে অজান্তেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী অনুশীলন দলে।
অনুশীলন দলে যোগ দেওয়ায় রণেশ দাশগুপ্ত বাঁকুড়া কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। সেখানেও ইংরেজ পুলিশের উৎপাত। পড়াশোনায় ভীষণ বিঘ্ন ঘটায় বাধ্য হয়ে আসেন বরিশালে। ভর্তি হলেন ব্রজমোহন কলেজে। থাকতেন কবি জীবনানন্দ দাশদের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন তার মাতুল।
পরে তার বাবা অবসর নিলে সপরিবারে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাউরদিয়া গ্রামে চলে যান রণেশ দাশগুপ্ত। কিন্তু গাউরদিয়া গ্রামেও থাকতে পারলেন না। পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল তাদের গ্রাম। এরপর বাধ্য হয়েই ঢাকা শহরে চলে আসেন। সংসারে তখন অভাবের ঢেউ। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রণেশ দাশগুপ্তকে সাংবাদিকতার চাকরি নিতে হয়। সেই প্রথম চাকরি সোনার বাংলা পত্রিকায়। লেখালেখির জগতে রণেশ দাশগুপ্তের হাতেখড়ি হয় এই পত্রিকাতেই।
ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে একটি লেখাই রণেশ দাশগুপ্তকে টেনে নিলো লেখালেখির জগতে। একসময় বামপন্থী রাজনীতি তাকে এতো বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল যে স্বদেশিয়ানা থেকে বামপন্থী রাজনীতির দিকেই পরিপূর্ণভাবে ঝুঁকে গেলেন তিনি।
ঢাকায় প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে উঠেছিল তার হাত ধরেই। একই সঙ্গে অচ্যুত গোস্বামী, সোমেন চন্দদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রগতি লেখক সংঘ। সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ডের পর কিরণ শংকর সেনগুপ্ত এবং রণেশ দাশগুপ্ত যৌথভাবে সম্পাদনা করতেন প্রগতি লেখক সংঘের পাক্ষিক মুখপত্র 'প্রতিরোধ' নামের অসাধারণ এক সংকলন। যেখানে প্রায় সব সম্পাদকীয়ও ছিল তার লেখা।
কারাগারের জীবন ছিল রণেশ দাশগুপ্তের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। দেশভাগের আগে তো বটেই দেশভাগের পরেও প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য জেলে যেতে হয়েছিল রণেশ দাশগুপ্তকে। একসময় জেলই হয়ে পড়ল তার ঘরবাড়ি। একবার জেলে যান তো মুক্তি পান, ফের কদিন বাদে জেলে। অপরাধ একটাই; বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি। গোটা পাকিস্তান শাসনামলই এমন কেটেছে। এরই মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মুনীর চৌধুরীকে কারাগারের নিভৃতে 'কবর' নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনিই । আবার 'কবর' নাটক তার প্রচেষ্টাতেই কারাগারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। মুক্তির ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন 'সংবাদ' পত্রিকায়। সংবাদ পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করে তুলতে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের সময়ে ফের গ্রেপ্তার হন রণেশ দাশগুপ্ত। ছাড়া পান এক বছর পরে। ছাড়া পেলেও একই বছর তাকে আবার আটক করা হয়। জেল থেকে সর্বশেষ রণেশ দাশগুপ্ত ছাড়া পান '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সুবাদে। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর রণেশ দাশগুপ্ত শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যেন সেন সহ একঝাঁক তরুণকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন 'উদীচী'। জন্মলগ্ন থেকে উদীচী অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম করে এসেছে। সেই উদীচী দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ে বাংলার শহর হতে বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে।
মুক্তিযুদ্ধের বছর রণেশ দাশগুপ্ত ভারতে চলে গিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। এসময়ে কলকাতায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সভা সমিতিতে বক্তব্য থেকে পত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য নিবন্ধ, সবই তিনি লিখতেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসেছিলেন কিন্তু অনেকটাই নীরবে নিভৃতে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় একটি সভায় যোগ দিতে গেলেন। আর দেশে ফিরেই এলেন না। একপ্রকার অভিমান ও ছিল তার। শেষমেশ কলকাতাতেই স্বেচ্ছানির্বাসিতের জীবন বেছে নিলেন মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত।
প্রচণ্ড অর্থকষ্টে থাকা সত্ত্বেও না বলার মতো ক্ষমতা ছিল রণেশ দাশগুপ্তের। তৎকালীন ভারত সরকার তাকে ভাতা দিতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, 'আমি একজন বাঙালি, আমি তোমাদের দেওয়া কোনো ভাতা নেবো না।' এমনকি ভারতে থাকাকালীন ভারতের নাগরিকত্বও নেননি তিনি।
'আলো দিয়ে আলো জ্বালা', 'উপন্যাসের শিল্পরূপ', 'শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে', 'ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম', 'কখনো চম্পা কখনো অতশী'র মতো অসামান্য সব প্রবন্ধের জন্ম রণেশ দাশগুপ্তের হাতে। আবার জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাব্যসমগ্রের সম্পাদনাও হলো তার হাতে। অনুবাদ করলেন উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা। কয়েকটি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। কিন্তু জীবনে মানিয়ে চলা বা স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার সত্ত্বা ছিলেন না রণেশ দাশগুপ্ত।
তার জীবনযাপনের বর্ণনা চোখে পড়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সম্পাদিত 'যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা' তে। যেখানে মতিউর রহমান লিখেছিলেন, 'রণেশদা ঢাকার তাঁতিবাজারের এক বাসার দোতলার এক কোঠার ছোট্ট একটা ঘরে থাকতেন। ঘরে দাঁড়ানো যেত না। কেবল কোনো রকমে শুয়ে-বসে কাজ করতেন, ঘুমোতেন। কলকাতার লেনিন স্কুলেও একই ধরনের পরিবেশে থাকতেন। সেখানে ছিল একটিমাত্র চৌকি। তাতে বসেই করতেন পড়াশোনা, লেখালেখি থেকে শুরু করে সবকিছু।'
রণেশ দাশগুপ্তের যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন বলা যায় তা এক বুদ্ধের জীবন কিংবা সন্তের জীবন। যে জীবন কেবলই ত্যাগের। এক মহান আদর্শের পিছনে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। রণেশ দাশগুপ্তের জীবনের দিকে তাকালে আজকের পৃথিবীতে কখনো কখনো অবিশ্বাস্য লাগে। এক জীবন এমন ভাবেও কাটানো সম্ভব। হয়তো রণেশ দাশগুপ্ত বলেই সম্ভব।
আজ কিংবদন্তী রণেশ দাশগুপ্তের ১১০তম জন্মবার্ষিকী। তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র:
যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা - রণেশ দাশগুপ্ত/ সংগ্রহ ও সম্পাদনা: মতিউর রহমান
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments