রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সবুজ চা বাগানও
১৯৭১ সালের ৩ মে বিকেল। মৌলভীবাজারের দেওরাছড়া চা বাগানে প্রবেশ করল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি। বাগানের অবাঙালি ম্যানেজার ২৫ মার্চের আগেই পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। অভিভাবকহীন শ্রমিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
শ্রমিকদের বেশিরভাগ দরিদ্র। বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া রেশন আর সাপ্তাহিক বেতন দিয়েই পরিবারকে নিয়ে তাদের চলতে হয়।
মার্চের শুরুতে রেশন ফুরিয়ে গেলেও, আর দেওয়া হয়নি। ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর পাননি বেতনও। কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন তারা।
সেই বিকেলে রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী বন্দুকের মুখে শ্রমিকদের জড়ো করে। রেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাকে ওঠানো হয় তাদের।
মাত্র ১০ মিনিটে ট্রাকগুলো এস্টেটের বাংলোর সামনে গিয়ে থামে। শ্রমিকদের ট্রাক থেকে নামিয়ে, বেঁধে লাইনে দাঁড় করানো হয়।
এরপর পাক সেনারা তাদের ওপর গুলি চালায় এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
দেওরাছড়া চা বাগানের ৫৪ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়। সেদিন বেঁচে যাওয়া ১২ জনের কেউই আর বেঁচে নেই।
তবে পাক হানাদারদের ধড়পাকড়ের সময়ে লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন চা বাগানের শ্রমিক অনুকূল গঞ্জু। পরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সে সব দিনের গল্প শোনান অনুকূল গঞ্জু।
১৯৭১ সালে কেবল দেওরাছড়া চা বাগানেই গণহত্যা চালানো হয়নি।
'চা বাগানে গণহত্যা: ১৯৭১' শীর্ষক অপূর্ব শর্মার গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ৬৬টি চা বাগানে ৫৪৫ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বাগানের শ্রমিক। তবে নিহতদের মধ্যে কয়েকজন কর্মী ও মালিকও ছিলেন।
গবেষক-লেখক দীপংকর মোহান্তের 'মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চা-শ্রমিক' বইতে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৫৮৮ জন চা বাগানের শহীদদের তালিকা করা হয়েছে।
চা শ্রমিকরা বেশিরভাগই অমুসলিম এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ায়, তাদের প্রতি পাক বাহিনীর তীব্র ক্ষোভ ছিল বলে অপূর্ব শর্মা তার বইতে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া, সেনারা বাগানগুলোকে কৌশলগত অবস্থান হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিল এবং অনেক অফিসার বাংলোগুলোকে থাকার জায়গা হিসেবে বেশ পছন্দ করেছিল।
বইতে বলা হয়, পাক সেনারা বাগানে ঢুকে বাঙালি কর্মচারী ও মালিকদের হত্যা করে এবং এস্টেট দখল করে নেয়।
১৮ এপ্রিল সিলেটের তারাপুর চা বাগানে ৪১ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। নিহতদের মধ্যে বাগানের মালিক পরিবারের ৫ সদস্যও ছিলেন।
পরদিন সিলেটের খাদিম চা বাগানে ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়। সেই বাগানেই শ্রমিকদের ঘরে বন্ধ করে বাইরে থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শ্রমিকদের ঘরে আটকে আগুন দিয়েও হত্যা করা হয়।
অপূর্ব শর্মার বইতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল ও মে মাস ছিল চা বাগানের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ওই ২ মাসে অন্তত ৪৫৫ জনকে হত্যা করা হয়।
প্রতিরোধ পর্ব
যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে চা বাগানের শ্রমিকরা হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে মহাসড়ক অবরোধ করে সিলেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চা বাগান দখলের বিরুদ্ধেও তারা বিদ্রোহের চেষ্টা করে।
অনেক বাগানের মালিক, ম্যানেজার ও কর্মচারীরা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন।
দীপংকর মোহান্তের বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ২৯৬ জন চা বাগান কর্মীকে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে চা বাগানের অন্তত আরও ১৪৫ জন দেশের জন্য লড়াই করেও কোনো স্বীকৃতি পাননি।
চা বাগানের বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ স্বীকারের গল্পগুলো খুঁজে পেতে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়েছে বলেও বইটিতে উল্লেখ করা হয়।
'এই ধরনের নির্মম নির্যাতন এবং বীরাঙ্গনাদের গল্প অনেকের কাছেই অজানা। কারণ বেশিরভাগ ভুক্তভোগীরা লজ্জায় তা বলতে চান না,' বইটিতে বলা হয়।
তবে সালগী খাড়িয়া, লক্ষ্মী সবর এবং মুরতিয়া রবিদাসসহ ২৫ জন বীরাঙ্গনার আত্মদানের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে।
এত বীরাঙ্গনার মধ্যে কেবল হবিগঞ্জের চানপুর চা বাগানের হীরামনি সাঁওতাল এবং সাবিত্রী নায়েক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
হীরামনি ২০১৬ সালের মার্চ মাসে মারা যান।
নেই কোনো স্বীকৃতি
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অনুকূল গঞ্জুর মতো চা বাগানের মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই ও বীরত্বের গল্প অনেক কম ক্ষেত্রেই আলোচনায় আসে।
অপূর্ব শর্মা বলেন, 'ব্রিটিশ আমল থেকেই চা বাগানের শ্রমিকরা প্রকৃত সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ এবং আত্মত্যাগের পরেও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।'
প্রায় প্রতিটি চা বাগানে গণহত্যার স্মৃতিফলক এবং স্মৃতিসৌধ আছে। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
তাছাড়া গত ৫০ বছরে চা বাগান শ্রমিকদের ত্যাগের স্বীকৃতি দিতে জাতীয় পর্যায়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় চা বাগানের মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনাগুলোও জাদুঘরে নথিভুক্ত করা হবে।'
Comments