‘তাদের হাতে লাশের গ্রামে পরিণত হয় মানিকগঞ্জের তেরশ্রী’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে যে কয়েকটি বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার অন্যতম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর, সূর্য যখন পূব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক সেসময় ঘিওর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা আক্রমণ চালায় জেলার প্রগতিশীল মানুষের আশ্রয়স্থল তেরশ্রী গ্রামে।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে হামলা চালানো হয় সেনপাড়ার ঘুমন্ত মানুষের উপর। বাড়ি-ঘরে আগুন, গুলি, চিৎকার আর আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। আতঙ্কিত গ্রামবাসী প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছে।
সেই দিনের বর্বরোচিত হামলায় তেরশ্রী গ্রামের জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়।
সেদিনকার সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা করেছেন জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর ছেলে কেএন ইনস্টিটিউশনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোমেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধারা।
সোমেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বয়স তখন ১২ বছর। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। গ্রামে আক্রমণের সংবাদ শুনে বাড়ির পাশে ধোপাবাড়িতে আশ্রয় নেন আমার বাবা জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী। কিন্তু, দেশীয় দালালরা সেখানে হানাদারদের নিয়ে যায়। তাকে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় তাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে তার কলেজের কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় তেরশ্রী বাজারে। মিন্টু মিয়ার মুদি দোকানে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।'
'কেএন ইনস্টিটিউশনের দপ্তরি মাখন লাল সরকারকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এভাবে একে একে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়। বেলা ১২টা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালিয়ে ঘিওরে ফিরে যায়। তাদের হাতে লাশের গ্রামে পরিণত হয় মানিকগঞ্জের তেরশ্রী।'
'এ হত্যাযজ্ঞ যারা দেখেছেন তারাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। পরে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান মিলে লাশগুলোকে গণকবর দেয়,' যোগ করেন তিনি।
সোমেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার মাকে সান্ত্বনা স্বরূপ একটি চিঠি দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর্থিক সহায়তাও দিয়েছিলেন। আমার পরিবারের জন্য সেটা অত্যন্ত মর্যাদার ছিল। তবে, শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আমরা স্বীকৃতি পাইনি।'
'মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মতো শহীদ পরিবারের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরিসহ সবক্ষেত্রে কোটা থাকা দরকার। শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আমি এই দাবি করছি।'
তিনি আরও বলেন, '২২ নভেম্বর তেরশ্রী গণহত্যা দিবসের ভয়াল স্মৃতিকে স্মরণ করতে ১৯৯৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের রাজনৈতিক দল, স্থানীয় তরুণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা "শহীদ স্মৃতি পরিষদ" গঠন করেন। ১৯৯৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমার মা গায়ত্রী দেবী চৌধুরানী স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর ২২ নভেম্বর এখানে গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আজাহারুল ইসলাম আরজু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তেরশ্রী ছিল শিক্ষানুরাগী, হিন্দুপ্রধান, বাম প্রগতিশীল তথা শিক্ষা সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৯৭১ সালে আশপাশের অনেক এলাকা থেকে বহু লোক এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তেরশ্রীতে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। এখানে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার প্রভাব মানিকগঞ্জেও এসে পড়ে। এখানে গঠিত হয় "মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ"। মানিকগঞ্জের প্রগতিশীল ছাত্র ও ব্যক্তিরা এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানি পুলিশ প্রশাসন তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশন ৪ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তেরশ্রীর লোকজন পায়ে হেঁটে ঢাকা গিয়ে তৎকালীন গভর্নর সোলায়মান খানের বাসভবন ঘেরাও করেন।'
'ব্রিটিশ পুলিশের কাছেও তেরশ্রী ছিল "রেড এরিয়া" অর্থাৎ কমিউনিস্ট এলাকা। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল তেরশ্রী গ্রাম,' যোগ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার প্রকৌশলী তোবারক হোসেন লুডু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তেরশ্রী গণহত্যা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। ২০১২ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তেরশ্রী এলাকায় সড়কের পাশে নির্মাণ করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে ৩৬ জন শহীদের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নাম-পরিচয় না জানার কারণে বাকি ৭ জনের নাম সেখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি।'
Comments