ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদের কবিতা ‘স্মৃতিস্তম্ভ’

ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

'স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?

ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো

চারকোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো!

যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য

পারেনি ভাঙতে'

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে লেখা কবিতা 'স্মৃতিস্তম্ভ'। লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আলাউদ্দিন আল আজাদ। তিনি তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। নিজেও ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ছাত্রদের মতো আলাউদ্দিন আল আজাদও হাজির হয়েছিলেন মিছিলে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে মিছিলেই  শহীদ হন  আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বারসহ বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী ও শিক্ষার্থী। এদিন মিছিলে থাকায়  আলাউদ্দিন আল আজাদ স্বচক্ষে দেখেছিলেন পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া জগন্নাথ কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন আহমদের নির্মম  মৃত্যু। তিনি দেখেছিলেন ভাষা শহীদ আব্দুল বরকত এবং আবদুল জব্বারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্যও।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যেই  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তৈরি করলেন ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। সেদিন সকালে সেই শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ শফিউরের বাবা। পরের ২দিন শহীদ মিনারটি দাঁড়িয়ে ছিল স্বমহিমায়।

২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালনোর প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি আইনসভার সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন তিনি। এদিনও সেখানে হাজির ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।  ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে নুরুল আমীন প্রশাসনের নির্দেশে  পুলিশ এসে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল ছাত্রাবাস ঘিরে ফেলে। এরপর আরেকটি ট্রাকে করে ইমারত ভাঙার জিনিসপত্র নিয়ে এসে স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

আলাউদ্দিন আল আজাদ তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতেই তিনি ইকবাল হলে বসে লেখেন 'স্মৃতিস্তম্ভ' কবিতাটি। তার কবিতায় কেবল শহীদ মিনার ভাঙ্গার প্রসঙ্গই নয়, উঠে এসেছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীপ্ত শপথের প্রসঙ্গও।

'এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।

            তাই আমাদের

হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক

            শপথের ভাস্কর।'

একুশের ছাত্র হত্যার পর রচিত হয়েছিল একুশের প্রথম বুলেটিন 'বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করি'। এখানেই ঠাঁই পেয়েছিলো আলাউদ্দিন আল আজাদের রচিত 'স্মৃতিস্তম্ভ' কবিতাটি। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলনেও ঠাঁই পেয়েছিল এই কবিতা।  

কবি ও ভাষা সংগ্রামী আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত 'স্মৃতিস্তম্ভ' কবিতাটির পুরোটা এ রকম–

'স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো

          চারকোটি পরিবার

খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য

          পারেনি ভাঙতে

হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার

খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে

          যারা বুনি ধান

গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই

সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।

           ইটের মিনার

ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী

           চারকোটি পরিবার ।

এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?

হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং

সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং

এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,

বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার

হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার

পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?

ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা

           চারকোটি কারিগর

বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।

           পলাশের আর

রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়

দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই

            শহীদের নাম

এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।

            তাই আমাদের

হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক

            শপথের ভাস্কর ।" 

সূত্র: আলাউদ্দিন আল আজাদ জীবন সাহিত্য, সম্পাদনা সিকদার আবুল বাশার 

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

6h ago