ডকইয়ার্ডের শ্রমিক থেকে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একজন মুক্তিযোদ্ধাই একই খেতাব দুবার পেয়েছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক। এই মুক্তিযোদ্ধার অসম সাহসিকতা ও বীরত্বের ঘটনা শুনলে চোখ কপালে উঠবে যে কারোই। মুক্তিযুদ্ধের আগে যে জহুরুল হক মুন্সী ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডের সাধারণ এক শ্রমিক, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনিই হয়ে উঠলেন পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎ যম। তার একের পর এক অপারেশনে পর্যুদুস্ত হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কখনো কৃষকের বেশ, কখনো ভিক্ষুক, কখনো কলা বিক্রেতা, কখনো মাওলানার ছদ্মবেশে তিনি চালিয়েছেন শ্বাসরুদ্ধকর সব অপারেশন।
এই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার মুখে রণাঙ্গনে তার অপারেশনের কাহিনী শুনতে হাজির হয়েছিলাম তার বাড়ি শেরপুরের শ্রীবর্দিতে।
ডকইয়ার্ডের শ্রমিক থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান
জহুরুল হক মুন্সী ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ডের শ্রমিক। ১৯৬৪ সালে একবার ডকইয়ার্ড থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে আনসারের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তার ভাবনায় ছিল, 'যদি কখনো দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়, তখন দেশের জন্য লড়াই করতে হবে।' ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছালে নারায়ণগঞ্জ থানার পুলিশ ও আনসারদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে তারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের দুপাশে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ২৭ মার্চ যখন পাকিস্তানি বাহিনী নারায়ণগঞ্জে ঢুকল তাদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে অপ্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে জহুরুল হক মুন্সীসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইল ও জামালপুর দিয়ে পায়ে হেঁটে বকশীগঞ্জ হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন।
ভারতে প্রশিক্ষণ
১২ এপ্রিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে পৌঁছানোর পরে ১৫ এপ্রিল মহেন্দ্রগঞ্জে বিএসএফের ক্যাপ্টেন নিয়োগীর অধীনে প্রশিক্ষণ শুরু হয় জহুরুল হক মুন্সীসহ আগত মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রথম দিকে ভারত সরকার বিএসএফকেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিল। মাত্র কয়েকদিন প্রশিক্ষণের পর এপ্রিল মাসের ২২/২১ তারিখের দিকে মহেন্দ্রগঞ্জ ছেড়ে নিকটবর্তী বাংলাদেশের ধানুয়া কামালপুর হয়ে জহুরুল হক মুন্সী এবং বিএসএফের সদস্যরা চারটি জিপে করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর বেশ কয়েকটি অপারেশন করেছিলেন তারা। বিশেষ করে রাস্তা ঘাটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন, কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া। মূলত দিনে এসে হামলা করে তারা দিনেই ভারতে ফিরে যেতেন। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দেয় তখন। বিশেষ করে বিএসএফকে দায়িত্ব দেওয়ার পর এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখের দিকে বিএসএফের বেশ কয়েকজন সদস্য সীমিত অস্ত্র ভাণ্ডারেই বাংলাদেশে ঢুকে পাকিস্তানই বাহিনীর উপর আক্রমণ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেবার পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে চূড়ান্ত নিগৃহীত হওয়ার পরে ভারত সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
তখন ২৯ এপ্রিল ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের জন্য ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডকে নিযুক্ত করে। ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডের অধীনে আনা হয় বিএসএফকেও। এসময় জহুরুল হক মুন্সী ও আরও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন। তাদের প্রশিক্ষণ হয় মেঘালয়ের তুরায়। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাদের পাঠানো হয় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রশিক্ষণ শেষে জহুরুল হক মুন্সী মহেন্দ্রগঞ্জে ফিরে এলেন। দুদিন পরেই তাকে ও আরও এগারোজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয় তুরা থেকে ১২ মাইল উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চল তেলঢালায়।
সেখানে মেজর জিয়াউর রহমানকে নেতৃত্ব দিয়ে ১ম, তৃতীয় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একত্রিত করে গড়ে তোলা হয়েছে জেড ফোর্স। ১০ সেপ্টেম্বর তেলঢালায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধীনে লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমানের অধীনে পরিকল্পনা করা হয় গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর উপরের স্লুইসগেট ধ্বংস করার জন্য। এরপর এই অপারেশনের জন্য ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এটিই ছিল জহুরুল হক মুন্সীর প্রথম উল্লেখযোগ্য অপারেশন। এই অপারেশনের কমান্ডার করা হয় জহুরুল হক মুন্সীকে। অপারেশনে জহুরুল হক মুন্সী বিস্ফোরক স্বল্পতায় পুরোপুরি স্লুইসগেট উড়িয়ে দিতে না পারলেও পাকিস্তানিদের সংযোগ যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন।
জঙ্গি পল্টনে যোগ দেওয়া
১ম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সংক্ষিপ্ত নাম ছিল জঙ্গি পল্টন। ১ম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি ছিল ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অন্তর্গত। ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার আর ১ম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লের।
এই মারাঠা ব্যাটেলিয়নের অধীনেই দুর্ধর্ষ সব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জহুরুল হক মুন্সী। মারাঠা ফার্স্ট ব্যাটেলিয়ন যেন তাকে ছাড়া কল্পানাই করা যেতনা।
বিষ মাখানো কলা, মারা গেল ১৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য
৫ নভেম্বর মাইনকারচরের ক্যাপ্টেন রাও জহুরুল হক মুন্সীকে বললেন, 'তুমি তো গেরিলা কমান্ডার। গাইবান্ধার ট্রেজারি এলাকার পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করতে হবে। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে। তারা ভীষণ অত্যাচার করছে বিভিন্ন জায়গায়। একটা অপারেশন করতে হবে। তুমি ভেবে দেখো।' এরপর মুন্সী কিছুক্ষণ ভেবে একটি বুদ্ধি বের করলেন। তুরা হাসপাতালে ডা. অমর সিংকে সেই পরিকল্পনার কথা খুলে বললেন মুন্সী। জোগাড় করা হলো ৪০টি কলা। দশটি কলা রেখে বাকি ৩০টি কলার মধ্যে বিষ ঢোকানো হলো। বাকি ১০টি কলার মধ্যে চুন দিয়ে হালকা চিহ্ন রাখা হলো, যেন দেখেই চিহ্নিত করা যায়। কারণ পাকিস্তানিদের কাছে কলা বিক্রি করতে গেলে প্রথমে মুন্সীকে খেতে বাধ্য করা হবে। কলা নিয়ে তিনি চললেন গাইবান্ধার উদ্দেশে। আগে ক্যাম্প থেকে কয়েক মাইল দূরে পাট খেতের মধ্যে নিজের সঙ্গে থাকা অস্ত্র রাখলেন। তারপর গাইবান্ধার ট্রেজারি এলাকায় ৬ নভেম্বর দুপুরের খাবারের সময়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঝাঁকা মাথায় কলা নিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি।
ক্যাম্পের সেন্ট্রি মুন্সীর মাথায় ঝাঁকা দেখেই জিজ্ঞেস করলো 'ঝাঁকায় কি?' মুন্সী বললেন, 'সাগর কলা।' সেন্ট্রি বলল, 'দেখি নিচে নামাও।' একজন এসে বলল, 'সবগুলো কতো দাম চাও?' মুন্সী বললেন, 'প্রতি হালি এক টাকা।' পাকিস্তানি সৈন্য বলল 'দাম বেশি বলেছ! কিছু কম বলো।' তখন মুন্সী বললেন, 'ঠিক আছে তোমরা নাও। তোমরা যা দিবে দিবে।'
কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিদের এক সুবেদার মেজর সন্দেহের বশে বলল, 'আগে তুমি একটা খেয়ে নাও।' মুন্সীও বুঝতে পেরে চিহ্নিত কলার মধ্যে একটি খেয়ে ফেললেন। খাওয়ার পরে পাকিস্তানিরা সব কলাই নিয়ে নিলো। আধা ঘণ্টা বসে রইলেন মুন্সী। মুন্সী অপেক্ষায় রইলেন কখন খাবার শেষ হবে। খাওয়ার পরেই তো ওরা ফল খাবে।
কিছুক্ষণ পর সেন্ট্রি এসে বলল, কি হলো তুমি এখনো বসে আছো কেন? মুন্সী বললেন, 'এখনো তো পয়সা পাইনি।' সেন্ট্রি গালি দিয়ে বলল, 'তোমাদের দেশ মুক্ত করছি আমরা। আবার কলার দাম চাও! যা ভাগ এখনই।' বলেই পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বিদায় করল। হেঁটে কিছুদূর আসার পরে মুন্সী দেখলেন পাকিস্তানিদের ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একজন দৌড়ে এসে দোকানের সামনে এসে সবাইকে বলছে পাকিস্তানিরা কলা খেয়ে ২৮ জন মারা গেছে।'
ঝোলাইপাড় অ্যামবুশ, ১০৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত
৯ নভেম্বর মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মাওলানার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে ঢুকলেন মুন্সী। গায়ে জোব্বা মাথায় টুপি, মুখে নকল দাঁড়ি, গলায় কোরআন শরীফ ঝোলানো। দেখেই মনে হবে বড় মাওলানা। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি কমান্ডার মেজর আইয়ুব তখন বক্সিগঞ্জে। মুন্সী মেজর আইয়ুবের জন্য একটি ঝুড়িতে কিছু ডিম আর বাদাম নিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে মুরগির ডিম আর বাদাম নিয়ে এক ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে বললেন, 'মেজর সাহেবের সঙ্গে দেখা করব।' পরনের পোশাক পরিচ্ছেদ সবাই তাকে ভাবল মাওলানা। মেজর আইয়ুব শুনেই ডেকে পাঠালেন মুন্সীকে। মুন্সী গিয়েই ডিম ও বাদাম মেজর আইয়ুবের হাতে তুলে দিলেন। এরপর মুন্সী মেজর আইয়ুবকে বললেন, 'আমাদের দেশ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাও। একমাত্র তোমরাই পারবে। তখন মেজর আইয়ুব গদগদ হয়ে বলেন, 'আমাদের জন্য দোয়া করুন মাওলানা সাহেব। আপনাদের কামালপুর পর্যন্ত আজাদ হয়ে যাবে। আমরা এটি মুক্ত করে দেবো।'
নানা কথা বার্তার এক পর্যায়ে মেজর আইয়ুব বললেন, 'বকশিগঞ্জ থেকে কামালপুর পর্যন্ত রাস্তার নকশা দেখিয়ে বললেন, 'এই পথ দিয়েই আমরা যাব। ১৪ নভেম্বর রাতে নয়টার দিকে আমরা কামালপুর আক্রমণ করব। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত প্রয়োজনে আমরা অপারেশন চালাব।' কিছুক্ষণ পর মুন্সী ক্যাম্প থেকে বেরিয়েই ওয়্যারলেসে সেই খবর মারাঠা ব্যাটেলিয়নের ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের কাছে বললেন। মুন্সীর কাছে এই খবর পেয়ে খানিকটা চমকিত হলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। এরপর সেদিন পুরো ব্যাটেলিয়নকে জহুরুল হক মুন্সীর অধীনে দেওয়া হলো। কারণ অ্যামবুশ করলে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন।
১৪ নভেম্বর অপারেশনের দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। সেদিন সন্ধ্যায় মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ব্যাটেলিয়ন সুদ্ধ রওয়ানা হয়েছিলেন মুন্সী। বাট্টাজোড় মহিনুদ্দিন মোল্লার বাড়ির বাগানে বাঙ্কার খুঁড়ে অবস্থান নেন ভারতীয় সৈন্যরা। বাগানের কারণে সড়ক থেকে কিছুই দেখা যায় না। সন্ধ্যার পরে রাতেই ৩৫টি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পুঁতলেন মুন্সী। সঙ্গে লাগালেন ক্যামোফ্লেজ।
পাকিস্তানি বাহিনীর দেখা মিলছে না তখনো। রাত ৮টা পেরিয়ে ৯টা বাজলো, ১০টা বেজে গেল তবুও পাকিস্তানি সৈন্যরা আসলো না। মুন্সীর অবস্থান ছিল তখন পাশেই এক শিমুল গাছের চূড়ায়। পাকিস্তানিরা এলেই তিনি পিস্টল লাইট মারবেন। পিস্টল লাইট যখন ছড়িয়ে যাবে তখন ওরা আর কিছুই দেখবে না। তবে ওদেরকে দেখতে পারবে ভারতীয় সৈন্যরা। মুন্সী পিস্টল লাইট মারতেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি শুরু করল। আর অপেক্ষা করল না ভারতীয় সৈন্যরা। তারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করল। গুলির মধ্যেই গাড়ির বহর সামনে এগুতে একে একে বিস্ফোরিত হতে লাগলো অ্যান্টি পার্সোনাল মাইনগুলো। মাইন বিস্ফোরণে খৈয়ের মতো উড়তে লাগল পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িগুলো। এই ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর ছয়টি জিপ উড়ে গিয়ে ১০৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। পাকিস্তানিদের বহরে ছিল মোট আটটি জিপ। বাকি দুটি জিপ বক্সিগঞ্জের দিকে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছিল ভারতীয় বাহিনী। ১৩ জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় আটক করা হলো।
পাকিস্তানি গ্যারিসনে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে যাত্রা
৯ ডিসেম্বর জামালপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি ৩১ বেলুচের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদের কাছে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন জহুরুল হক মুন্সী।
এই আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে যাওয়ার আগে মারাঠা ফার্স্ট ব্যাটেলিয়ন অবস্থান নিয়েছিল জামালপুর থেকে দূরে বেল্ট নামক জায়গায়। ৯ ডিসেম্বর সকাল বেলা যুদ্ধের পরিকল্পনার এক পর্যায়ে ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত প্রায় ৬০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কাছে ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠানো হলো 'কে যাবে জামালপুরে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে?'। কেউই যাওয়ার সাহস করল না। এর এক পর্যায়ে ১০/১২জন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে আলাদা করা হলো। ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার এবার জিজ্ঞেস করলেন তাদের। বললেন, 'তোমাদের মধ্যে কে যাবে?'
কেউই হাত তুলল না।
কিছুক্ষণ পর ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লের বললেন, 'কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে?' তখন জহুরুল হক মুন্সী হাত তুললেন। বললেন, 'আমি আমার মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করব। আমিই আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যাবো।'
৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টার সময়ে সাইকেলে আত্মসমর্পণের চিঠি ও সাদা পতাকা নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে কৃষকের ছদ্মবেশে যাত্রা শুরু করলেন মুন্সী। জামালপুর পৌঁছানো মাত্রই পাকিস্তানি সৈন্যরা মুন্সীকে ধরে সাদা পতাকা ও গামছা দিয়ে চোখ ও হাত বেঁধে এবং কোমরে ও জীপের পিছনে চাকায় একপাশ দড়ি বেঁধে জামালপুর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে অবস্থিত পাকিস্তানিদের মূল ঘাঁটিতে নিয়ে গেল।
তখন কর্নেল সুলতান মাহমুদ খান এবং আলবদর নেতা কামরুজ্জামান গিয়েছিলো টাঙ্গাইলে। সারাদিন কিছু খাননি বলে ভীষণ ক্ষুধার্ত তখন মুন্সী। এক পর্যায়ে তিনি দেখলেন এভাবে বাঁচার উপায় নেই। তখন তিনি বললেন, 'আমি টয়লেটে যাবো।' টয়লেটেও তাকে নেওয়া হলো কোমরে দড়ি বেঁধে। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো সঙ্গে থাকা বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যটি। মুন্সীর শরীরে বাধা ছিলো বডি ওয়্যারলেস। টয়লেটে ঢুকেই তিনি প্রথমে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাম্পে ওয়্যারলেসে মেসেজ করলেন, 'ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের পাশেই পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। ওখানেই বোমা হামলা চালাবে।' কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে চারটি ভারতীয় বাহিনীর বিমান বোমা হামলা চালাল। এর মধ্যে বোমা হামলা হচ্ছে দেখে সব পাকিস্তানি সৈন্য পালিয়েছে। তখন জহুরুল হক মুন্সী হেঁটে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের খাটের নিচে ঢুকলেন। যেন ওরা সন্দেহ না করে তাকে। রাত ১১টার দিকে কর্নেল সুলতান এবং আলবদর নেতা কামরুজ্জামান এলেন। ওরা আসার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের সামনে। কর্নেল সুলতান মাহমুদ আত্মসমর্পণের চিঠি পড়ে ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। তৎক্ষণাৎ ম্যাগাজিন দিয়ে মুন্সীর চোয়ালে আঘাত করলেন। আঘাতে চারটি দাঁত পড়ে গেল মুন্সীর।
কর্নেল সুলতান মাহমুদ বললেন, 'তুমি মুক্তি! তোমাদের কি সাহস! আমার কাছে এসেছ সারেন্ডারের প্রস্তাব নিয়ে!' বলেই বেশ কয়েকটি রাইফেলের বাঁটের বাড়ি। মুন্সী বললেন, 'আমি নিরীহ কৃষক। মুক্তিবাহিনীর লোক না। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে। বলেছে না গেলে আমাকে মেরে ফেলবে।' কিন্তু কর্নেল সুলতান মাহমুদ শুনতে চাইলেন না সেসব। তার সাফ জবাব তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক।
টেবিলের উপর সুঁই দিয়ে নখের মাঝে ছিদ্র করে আঙ্গুলের হাড় ভাঙা হলো। এরপর উল্টোভাবে টাঙ্গিয়ে বলা হলো 'তুমি বাঙালি পাকিস্তানিদের চিনো? কোন সাহসে তুমি এই চিঠি নিয়ে এলে!' কিন্তু তখনো তার জবাব, 'আমি মুক্তিবাহিনীর লোক নই। আমি নিরীহ মানুষ।' প্রচণ্ড নির্যাতনের এক পর্যায়ে মুন্সী স্বীকার না করায় কর্নেল সুলতান মাহমুদ খান ভাবলেন, 'এ আসলেই হয়তো নিরীহ মানুষ। নয়তো এখনো কেন স্বীকার করছে না!' তখন পাকিস্তানিরা ৭.৬২ মিমি চাইনিজ রাইফেলের গুলি সাদা পতাকায় মুড়িয়ে বললেন, 'গিয়ে বলবে যুদ্ধ চলবে। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে না।'
জামালপুর মুক্ত
ভয়াবহ নির্যাতনে আহত জহুরুল হক মুন্সী সাইকেলে করে আসার সময় দেখলেন পথের দুপাশে অজস্র নিরীহ মানুষের লাশ পড়ে আছে। এক নারী গুরুর আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। তার গায়ের উপর মরে পড়ে আছে একটি শিশু। চারদিকে যেন লাশের স্রোত নেমেছে। পাখির মতো গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানিরা। আহত অবস্থার মধ্যে এসব দৃশ্য দেখে মাথায় আগুন ধরে গেল মুন্সীর। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হয় তিনি জামালপুর গ্যারিসন আক্রমণে মরবেন নয়তো পাকিস্তানিদের ধুলায় মিশিয়ে দিবেন। ঠিক করলেন তার জীবনের শেষ যুদ্ধ হবে জামালপুর গ্যারিসন আক্রমণ।
রাত ১২টার দিকে শরীরের শেষ শক্তি নিয়ে বেল্টে পৌঁছালেন মুন্সী। পৌঁছেই দেখলেন তার শরীরে আর একবিন্দু শক্তি নেই। পরদিন ভোরে চলল জামালপুর গ্যারিসন দখলের লক্ষ্যে ভয়াবহ আক্রমণ। এই আক্রমণে ২৩৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। জীবিত অবস্থায় আটক করা হয়েছিলো ৬১ জনকে। হানাদার মুক্ত হলো জামালপুর। আর সেই রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় কমান্ডার মেজর জেনারেল জি সি নাগরা বললেন, 'গতকাল পাকিস্তানিরা বাঘের লেজে মোচড় দিয়েছিল, আর আজ তার পরিণাম হাড়ে হাড়ে টের পেল।'
সূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড
মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান, দ্বিতীয় খণ্ড , বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
ahmadisitiak1952@gmail.com
Comments