জগন্নাথ হল গণহত্যা: আজও শিউরে উঠেন প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদদের স্বজন

জগন্নাথ হলের গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

২৫মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যতগুলো গণহত্যা চালিয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে বর্বর ছিল জগন্নাথ হলের গণহত্যা। ভয়াবহ ওই রাতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আজও শিউরে উঠেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদদের স্বজনরা।

২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছেন, তা এখনও অজানা। তবে ধারণা করা হয়, বুলডোজার দিয়ে মাটি খুঁড়ে জগন্নাথ হল মাঠে শতাধিক ছাত্র, কর্মচারী, শিক্ষক ও বস্তিবাসীকে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। এই শহীদদের বেশিরভাগই জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শহীদদের ৬৬ জনের নাম হলের গণকবরের নামফলকে স্থান পেয়েছে।

২৫ মার্চ কালরাতে জগন্নাথ হল গণহত্যার ভিডিও করেছিলেন বুয়েটের প্রয়াত অধ্যাপক নূরুল উলা। হলের পাশে বুয়েট শিক্ষকদের আবাসিক ভবনের জানালা দিয়ে করা এই ভিডিওতে ৩ ভাগে গণহত্যা চালানোর দৃশ্য দেখা যায়। তবে নূরুল উলা এর আগে আরও ৩ ভাগে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালাতে দেখেছেন।

শুরু যেভাবে

২৫ মার্চ সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ছিল থমথমে। চারদিকে ছিল চাপা উত্তেজনা। হলের বেশিরভাগ আবাসিক ছাত্র ২৫ মার্চের আগে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। যারা সেই রাতে হলে ছিলেন, তাদের অধিকাংশই টিউশনের জন্য রয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ অবশ্য পরদিন যাওয়ারও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু কে জানত, সেই সুযোগ আর মিলবে না!

এদিন সন্ধ্যার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় হলের ডাইনিং। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে বেশির ছাত্রই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ১২টার দিকে ইউওটিসির (বর্তমানের বিএনসিসি) দিক থেকে দেয়াল ভেঙে ট্যাঙ্ক নিয়ে জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনারা।

প্রথমেই তারা মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। একইসঙ্গে চলে মেশিনগানের ফায়ার। এরপর উর্দু ও ইংরেজিতে ছাত্রদের আত্মসমর্পণের জন্য বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয় তারা।

তারপর গেইট ভেঙে হলে প্রবেশ করে শুরু করে নির্বিচারে গুলি ও গোলাবর্ষণ। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করে ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। বাথরুমে, ছাদের পানির ট্যাঙ্কে লুকিয়েও সেদিন অনেক ছাত্র রক্ষা পাননি। বিভিন্ন কক্ষ থেকে ধরে আনা বেশ কয়েকজন ছাত্র, কর্মচারীদের দিয়ে মরদেহ টেনে মাঠে নিয়ে আসা হয়। বুলডোজার দিয়ে গণকবর খুঁড়ে সেগুলো মাটি চাপা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। যাদের দিয়ে মরদেহ টেনে আনানো হয়, তাদেরকেও মাঠে হত্যা করা হয়।

এইপাশ দিয়েই ফটক ভেঙে জগন্নাথ হলের মাঠে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

জগন্নাথ হল সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, হলে হাসান ও হোসেন নামের অনাথ ২ সহোদর থাকতেন। ডাইনিংয়ের বেঁচে যাওয়া খেয়েই দিন কাটত তাদের। ছাত্ররাও স্নেহ করতেন ২ ভাইকে। ২৫ মার্চ রাতে ২ ভাইকে দিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মরদেহ টানিয়েছিল হানাদাররা। কিন্তু তারাও প্রাণে বাঁচতে পারেনি।

সুনীল চন্দ্র দাস ছিলেন জগন্নাথ হলের নিরাপত্তাপ্রহরী। ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন তিনি। তার স্ত্রী বকুল রাণী দাস জগন্নাথ হল গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সেদিন রাত ১০টায় আমার স্বামী আমাকে ঘরে রেখে দরজার বাইরে তালা লাগিয়ে ডিউটিতে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল, বাচ্চাদের নিয়ে যেন শুয়ে পড়ি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকের গেইট ভাঙার শব্দ পাই। এরপর একটানা গুলির বিকট শব্দ। আমার এক প্রতিবেশী আমাকে ডাকতে এসে দরজায় তালাবদ্ধ দেখে ফিরে যান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমার স্বামী হন্তদন্ত হয়ে ফিরে বলল, ''চলো, আমরা এদিক থেকে পালাই।'' এরপর আমি স্বামী, ছেলে-মেয়ে ও প্রতিবেশীদের নিয়ে বের হতেই দেখি হলের মাঠে পাকিস্তানিরা লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করছে।'

অ্যাসেম্বলির পাশের একটি ঘরে সরস্বতীর প্রতিমা ছিল। ওইদিকটা অন্ধকার হওয়ায় আমরা এর পিছনে গিয়ে লুকাই। এদিকে মিলিটারিরা অ্যাসেম্বলিতে এসে তল্লাশি চালাতে শুরু করল। তখন আমাদের একজনের একটা বাচ্চা কেঁদে উঠে। মিলিটারিরা আলো নিয়ে খুঁজতে গিয়ে আমার স্বামীকে দেখতে পায়। তার কোলে ছিল আমাদের মেয়ে। আমার স্বামীকে যখন তারা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন  আমি এক সেনার পায়ে পড়ে বললাম, ''আপনারা আমার স্বামীকে কোথায় নিচ্ছেন?'' তখন সেই সেনা আমাকে বুট দিয়ে লাথি মারে। তারা আমার মেয়েকে ফেলে দিয়ে স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। আমি তখনই অজ্ঞান হয়ে যাই।

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে বাকিরা পালানোর জন্য তাড়া দেয়। অ্যাসেম্বলি থেকে বেরিয়ে দেখি, অ্যাসেম্বলির সামনে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে নিয়ে আসছে ওরা। এরপর তাকেসহ আরও অনেককে মাঠে সারিবদ্ধভাবে এক পায়ে দাঁড় করানো হয়। একটানা গুলির শব্দ পাই। দেখি, লাইনে থাকা সবাই গুলি খেয়ে পড়ে গেছে।'

ভয়াবহ সেই রাতে পাকিস্তানিদের নির্দেশ মতো মরদেহ টেনে প্রাণে বাঁচতে পারেননি দাসু রাম রায়ও।

শহীদ দাসু রাম রায়ের মেয়ে গিরিজা রাণী রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিনের মতো আমার বাবা সন্ধ্যার দিকে রামায়ণ নিয়ে বসেন সেদিন। এরমধ্যে একজন এসে বললে,''আজকে বাইরে আবহাওয়া খারাপ। মিলিটারি আসছে রাতে। আপনারা সাবধানে থাইকেন।'' এরপর রাতে আমাদের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রাত ১২টার দিকে মিলিটারিরা আমার বাবাকে লাশ টানার কথা বলে ডেকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেলেও বাবার ফেরার নাম নেই। তখন আমি, আমার বোন ও নানী ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে গিয়ে দেখি, মাঠের মধ্যে ২ লাইনে সবাইকে দাঁড় করিয়েছে মিলিটারিরা। একজন স্টেনগান নিয়ে ব্রাশফায়ার করল তারা। মুহূর্তের মধ্যে সবাই পড়ে গেল। এরপর মিলিটারিরা কোথায় যেন গেল। আমরা গিয়ে বাবাকে খুঁজতে শুরু করি। 

শহীদ দাসু রাম রায়ের মেয়ে গিরিজা রাণী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

এক পর্যায়ে তাকে পেলাম। বাবা মাটিতে পড়ে আছেন। তার প্রাণ তখনো আছে। কেবল জল চাচ্ছেন। আমি জল এনে বাবার মুখে দিলাম। মুখে নিয়েই ঢলে পড়লেন। আমি তখন ভাবছি, বাবার তো কোথাও গুলি লাগেনি। তাহলে এমন ছটফট করতে করতে কি অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি? কিন্তু পরে খেয়াল করলাম, বাবার ২ কানে রক্ত। বুঝলাম, গুলি এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে।'

পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব চলেছিল পরদিন সকাল পর্যন্ত। জগন্নাথ হলের পূর্ব পাশে একটি ৪ তলা বাড়ির ২ তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে। ২৬ মার্চ সকালে এই বাড়িতেই মধুসূদন দের স্ত্রী যোগমায়া দে, ছেলে রনজিৎ কুমার দে, পুত্রবধূ রীনা রানী দেকে হত্যা করে হানাদাররা। পরে মধুসূদন দেকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী মধুসূদন দের ছেলে অরুণ দে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকাল ৭টার দিকে হানাদারদের একটি গাড়ি এল আমাদের বাসায়, অন্যটি গেল জিসি দেবের (অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব) বাসায়। আমাদের বাড়িতে এসেই হানাদাররা জিজ্ঞেস করল, ''মধুদা কোথায়?'' বাবা তখন ছিলেন ৪ তলায়। তার দরজায় করাঘাত করলে বাবা নিজেই দরজা খুলে দেন। তখন তারা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর এক সেনা আমাদের ঘরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দাদা আর বউদিকে গুলি করে হত্যা করে তারা। আমার মাকে মারতে গেলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ''সবই তো শেষ করে দিলে। অন্তত আমার স্বামীকে মেরো না।''

হানাদারেরা তখন আমার মাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। মাকে গুলি করার সময় ২টি গুলি এসে লাগে বাবার পায়ে। তখন বাবাকে রেখে চলে গেলেও কিছুক্ষণ পর ওরা তাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে যায়। ততক্ষণে জিসি দেবকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে। এরপর বাবাসহ তাদেরকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদাররা।'

মৃত্যুপুরীতেও মনুষ্যত্বের খোঁজ

কালরাতের মৃত্যুপুরীর মধ্যেও পাওয়া গিয়েছিল ইদু মিয়া নামের এক বই বিক্রেতার অসামান্য মানবতাবোধ ও মনুষ্যত্বের পরিচয়। জগন্নাথ হলের পাশের বুয়েট মসজিদের সঙ্গেই ছিল ইদু মিয়ার দোকান।

প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ পরিবারের স্বজনরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ইদু মিয়া নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বাঁচিয়েছিলেন বহু মানুষের জীবন। জগন্নাথ হল মাঠে পাকিস্তানিরা ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও বস্তিবাসিকে হত্যার পর মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য বুলডোজার সংগ্রহের জন্য কিছুক্ষণ বিরতি নিয়েছিল। তখন ইদু মিয়া আহতদের মধ্যে অনেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে চানদেব, মতি, কালী, হরিধন দাস, ধীরেন বাবুসহ অনেকে প্রাণে বেঁচে যান।

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

3h ago