মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ হাবিলদার নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম

শহীদ হাবিলদার নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ হাবিলদার নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

হাবিলদার নাসির উদ্দিন শেরপুরের নকশী বিওপি যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৩৫।

১৯৭১ সালে হাবিলদার নাসির উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে। ১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করে আছে ১৪ এপ্রিলের আশুগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন হাবিলদার নাসির উদ্দিন। ৪ এপ্রিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা ভৈরব থেকে পিছু হটে নদীর ওপারে আশুগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপন করলে ভৈরব কার্যত পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যায়। ১৩ এপ্রিল বিকেলে লালপুরে পাকিস্তানি সেনারা গানবোট নিয়ে হামলা চালায়। আলফা কোম্পানির ৭৫ কিমি ট্যাংক বিধ্বংসী গোলায় শত্রুদের বেশ ক্ষতি হয়। ১৩ এপ্রিল রাতে ভৈরবে অবস্থানরত সব অবাঙালিকে ৩টি লঞ্চে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

১৪ এপ্রিল সকালে সেনা সমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এদিন ভোর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি স্যাবর জেট এফ৮৬ মেঘনা নদীর পশ্চিমে ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ বন্দর, লালপুর ও আশুগঞ্জ সাইলো এবং পাওয়ার স্টেশনের উপর বোমা হামলা শুরু করে। এর কিছুক্ষণ পরে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে ছত্রীসেনা নামায়।

সোহাগপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডোরা আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের পাশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করে। এরপর সোনারামপুরের দিকে এগিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে। আশুগঞ্জ বাজারে ২ জনকে হত্যা করে তারা আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছালে ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খানের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই দলের মধ্যে ছিলেন হাবিলদার নাসির উদ্দিন।

আশুগঞ্জের স্টেশন অনেকটা উঁচুতে হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। ২ পক্ষের মধ্যে তখন দূরত্ব ছিল মাত্র ৭০-৮০ গজ। এ সময় পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলোও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর প্রবল বোমাবর্ষণ শুরু করে। একইসঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী অনবরত মেশিনগান ও রকেট ফায়ার চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানিদের এমন হামলার মুখে হাবিলদার নাসির উদ্দিনসহ ইস্ট বেঙ্গলের সেনারা ট্যাংকে অবস্থান নেন। ভৈরব থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গ্রুপ আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকার দিকে পৌঁছালে রেলস্টেশনে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা ট্যাংক থেকে ফায়ার শুরু করে। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

মাত্র ২টি মেশিনগান নিয়ে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের সামনে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা বিরল ঘটনা। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে আহত হন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ও লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান।

এ সময় ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনের মেশিনগানের গুলিতে ১৫-২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই শহীদ হন। পরে ক্যাপ্টেন নাসিম ইস্ট বেঙ্গলের সেনাদের সরাইলের দিকে পিছু হটার নির্দেশ দেন।

সংগঠিত হওয়ার জন্য সেখান থেকে হাবিলদার নাসির উদ্দিন ভারতে প্রবেশ করেন। পরে তাকে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিযুক্ত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধগুলোর একটি নকশী বিওপির যুদ্ধ। এ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন হাবিলদার নাসির উদ্দিন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা নকশী বিওপি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এক ঘাঁটি। নকশী বিওপিতে মোতায়েন ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। ঠিক করা হয়, সেখানে আক্রমণ করবে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা ও ব্রাভো কোম্পানি।  

টানা ৩ দিন রেকির পর ৩ আগস্ট রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয়। আর্টিলারি ইউনিটে ছিলেন হাবিলদার নাসির উদ্দিন। এ সময় পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে।

পাকিস্তানি আর্টিলারির ৩টি শেল মুক্তিবাহিনীর এফইউপিতে এসে পড়ে। শেলের আঘাতে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। আরআরও মেশিনগান থেকে বিওপির উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাশের হালজাতি গ্রাম থেকে ২টি ইপিআর প্লাটুন গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এক্সটেনডেন্ট লাইনের সামনে এগোলে ক্যাপ্টেন আমীন মর্টার গ্রুপকে নালার আড়াল থেকে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন।

কিন্তু সেখানে স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিল। তারা নালার আড়াল থেকে আন্দাজ করে ফায়ার করতে শুরু করেন। এ সময় নায়েব সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর ৫, ৬ নম্বর প্লাটুনের বিওপির গেটের ভিতর দিয়ে ঢোকার কথা। কিন্তু ওই প্লাটুনও আড়াল থেকে এলোমেলো ফায়ার করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন আমীন চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ক্যাপ্টেন আমীন 'চার্জ' বলে আদেশ দিতেই হাবিলদার নাসির উদ্দিনসহ মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি বিওপি আক্রমণের জন্য দৌঁড়াতে শুরু করেন। বিওপির ১০০ গজের মধ্যে পৌঁছাতেই বিওপি থেকে একটি আর্টিলারি শেল এসে পড়ে হাবিলদার নাসির উদ্দিনের উপর। শহীদ হন তিনি।

মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে। ষাটের দশকে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরে তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে বদলি করা হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস

১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন / আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

6h ago