খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ মাহবুবুর রহমান,বীর উত্তম
(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ মাহবুবুর রহমান, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মাহবুবুর রহমান ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ২২।
১৯৭১ সালে মাহবুবুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। এরপর তিনি ত্রিপুরার আগরতলায় চলে গেলে তাকে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রটিং ক্যাম্পের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাকে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর তাকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কামালপুরের যুদ্ধকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। ১৮০ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। কামালপুরের প্রথম যুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান। কামালপুরের প্রথম যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি ছিল রোডব্লকের দায়িত্বে। এই দলে মোট ৬০ জন সেনা ছিল। ৩১ জুলাই রাতে আলফা কোম্পানি সীমান্ত অতিক্রম করে কামালপুরের এক মাইল দক্ষিণে কামালপুর-শ্রীবর্দী রোড জংশনে এবং উঠানিপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি বহর ধ্বংসের জন্য আধা পাকা রাস্তার উপর অ্যান্টি মাইন স্থাপন করে রোড ব্লক করে।
ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দলের প্রধান সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি বহর বিধ্বস্ত হলে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা। আলফা কোম্পানির মূল দলের ৩০০ গজ দক্ষিণে একটি ছোট দল অবস্থান নিয়েছিল। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে সম্ভাব্য সাহায্যকারী দলের আগমনের সংকেত দেওয়া এবং মূল দলের উপর ফায়ার শুরু হলে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা।
ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে কাট অফ পার্টির আরো একটি দল মূল দলের ২০০ গজ উত্তরে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এই দলের দায়িত্ব ছিল সাহায্যকারী পাকিস্তানি সেনাদের কামালপুর বিওপিতে পৌঁছতে বাধা দেয়া এবং পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা। কামালপুরের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে স্থাপিত এই রোডব্লক অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।
কামালপুর বিওপিতে হামলার কথা শুনে বকশীগঞ্জ কোম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে ২ ট্রাক পাকিস্তানি সেনা সাহায্যকারী হিসেবে কামালপুর বিওপির উদ্দেশে যাত্রা করে। ১ আগস্ট দিবাগত রাত সাড়ে ৪টা ৩০ মিনিটে উঠানিপাড়া এলাকায় স্থাপিত মাইনের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রাক ২টি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠিক সে সময় আলফা কোম্পানির কাট অফ পার্টির সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এ সময় ভূমিতে অবস্থান নেয়। ২ পক্ষের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী গুলি বিনিময়ের পর পাকিস্তানি বাহিনী এদিক সেদিক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ৮-১০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১২-১৩ জন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
কামালপুরের যুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৭১ জন আহত হন। এই যুদ্ধে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর বিওপি দখল করতে না পারলেও কাট অফ পার্টি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি চূড়ান্ত সাফল্য দেখিয়েছিল।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে সিলেট রণাঙ্গনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল সিলেটের যুদ্ধে গতিশীলতা এনে সিলেটকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা। ৪ অক্টোবর থেকে জেড ফোর্সের অধীনে থাকা বাহিনীগুলো সিলেটের দিকে যাত্রা শুরু করে। এরপর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে চা বাগানগুলোতে ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের পরিকল্পনা ছিল চা বাগানগুলো মুক্ত করে সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়া।
মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ধলই বিওপির যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে আলফা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ধলই বিওপির আক্রমণকালে টুইন হাট ও রেড হাট এলাকার পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে অনবরত গুলি নিক্ষেপ করে ব্যস্ত করে রাখার।
২৮ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালানো শুরু করে। আলফা কোম্পানির পরিকল্পনার জন্য ধলই বিওপি যুদ্ধে বাইরে থেকে সাহায্য আনতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সিলেটের কানাইঘাট যুদ্ধ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কানাইঘাট পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ২ পক্ষের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। সীমান্তবর্তী হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী কানাইঘাটে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী অক্টোবরের শেষ দিকে বুঝতে পারে, কানাইঘাটে যদি পাকিস্তানি বাহিনীর পতন ঘটে তবে সিলেট দখল করা সহজ হবে। ১৫ ও ২২ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হয়ে গেলে কানাইঘাট মুক্ত করাই মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তানি বাহিনী কানাইঘাটের প্রতিরক্ষায় রেখেছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি, পশ্চিম পাকিস্তানি স্কাউটস দলের একটি প্লাটুন এবং বেশ কয়েকজন রাজাকার। কাছাকাছি এলাকায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি আর্টিলারি ব্যাটারি।
২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সুরমা নদীর পাড়ে ছোটগ্রাম গৌরিপুরে তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। সামনে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি ও ডেল্টা কোম্পানি রেখে পিছনে ব্রাভো ও চার্লি কোম্পানি নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়।
২৮ নভেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎই নিজেদের মূল ডিফেন্সিভ পজিশন ছেড়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এ সময় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের গুলিতে আহত হচ্ছিলেন। বৃষ্টির মতো গোলাগুলিতে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ম্যাপের গ্রিড রেফারেন্স জানিয়ে গোলা ফেলার অনুরোধ জানান তিনি। কারণ পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তুমুল গোলাগুলির মধ্যে হঠাৎ পাকিস্তানিদের ছোড়া একটি শেল ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের শরীরে লাগে। তিনি শহীদ হন। তবে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল মুক্তিবাহিনী।
মাহবুবুর রহমানের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৩ জুলাই দিনাজপুর শহরের ঈদগাহ বসতি এলাকায়। দিনাজপুর সেন্ট যোসেফ স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় তার। এরপর ১৯৬০ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৬২ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্র নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা ডেন্টাল কলেজে। ২ বছর পড়াশোনার পর ১৯৬৬ সালে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৮ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে কমিশন পান তিনি।
পরে লেফটেন্যান্ট পদে আজাদ কাশ্মীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে যোগ দেন। এরপর কুমিল্লাতে বদলি করা হয় মাহবুবুর রহমানকে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১০ম খণ্ড
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস
আহমাদ ইশতিয়াক
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments