মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ নায়েক আবদুল মান্নান, বীর উত্তম

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ নায়েক আবদুল মান্নান, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

নায়েক আবদুল মান্নান হবিগঞ্জের কালেঙ্গা জঙ্গলে অ্যামবুশ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ৩৬।

১৯৭১ সালে নায়েক আবদুল মান্নান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। এ সময় তিনি কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল গাজীপুরের জয়দেবপুরে।

৭ মার্চ গাজীপুরে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে থাকা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের নিরস্ত্র করতে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জাহান আলী জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। জয়দেবপুর রেল ক্রসিংয়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালালে ২ জন বাঙালি শহীদ হন।

১৯ মার্চ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার পদে রদবদল হয়। ২৫ মার্চ ঢাকায় নৃশংস গণহত্যার খবর জয়দেবপুরে এসে পৌঁছালে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনারা বুঝতে পারেন, ঢাকা থেকে এসে যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে পাকিস্তানি সেনারা। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে নায়েক আবদুল মান্নানসহ বাঙালি সেনারা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ যান।

পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে, সড়কপথে জয়দেবপুর দখল করা যাবে না। তাই ২৯ মার্চ সকাল ১১টায় বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে তারা। দুপুরের মধ্যেই জয়দেবপুরের দখল নেয় পাকিস্তানি বাহিনী।

১ এপ্রিল মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত রশিদপুর থেকে সদরদপ্তর মৌলভীবাজারে স্থানান্তর করেন। ৪ এপ্রিল মেজর শফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানিকে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেন। এই কোম্পানিতে ছিলেন নায়েক আবদুল মান্নান। এরপর তারা কুলাউড়া-শ্যাওলা সুতারকান্দি হয়ে গোপালগঞ্জ পৌঁছান।

৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানির ডানে ও বামে থাকা বাঙালি সেনারা নদী পার হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলবে এবং বাকি সেনারা পাকিস্তানি সেনাদের ব্যস্ত রাখবে। পরিকল্পনা করা হয়, ৫ এপ্রিল ভোরে শেরপুরে আক্রমণ করবে মুক্তিবাহিনী।

শেরপুরের যুদ্ধ ছিল সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর প্রথম পরিকল্পিত যুদ্ধ। শেরপুরে যুদ্ধের পর নায়েক আবদুল মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বাধায় গোপালগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। কদমতলীতে আসার পর পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু টিকতে না পেরে তারা সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। নায়েক আবদুল মান্নানসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিশ্বনাথের দখল নিয়ে কদমতলী থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেন এবং সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন।

৭ এপ্রিল সালুটিকর বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা বাগান ছাড়া পুরো সিলেট মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ২৬ এপ্রিল সিলেটের পতন হওয়ার পর ২য় ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানি ভারতের সখাপুঞ্জিতে আশ্রয় নেয়।

সেক্টর গঠন করার পর নায়েক আবদুল মান্নানকে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে আশ্রমবাড়ি সাব সেক্টরে নিয়োগ দেওয়া হয়। আশ্রমবাড়ি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিল কালেঙ্গা জঙ্গল, লালচান্দ চা বাগান, ধুপপাতিল, সীমান্ত সংলগ্ন আসামপাড়া ও হবিগঞ্জ মহকুমার চুনারুঘাট থানা। এই সাব সেক্টরের দায়িত্ব প্রথমে ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানকে এবং পরে ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরীকে দেওয়া হয়।

ধূপপাতিল গ্রামের অ্যামবুশ গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ ছিল। ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ কাঁচামাটি সাব সেক্টর ক্যাম্প থেকে ৩ মাইল ভেতরে ছিল সীমান্তবর্তী ধূপপাতিল গ্রাম। কাছাকাছি বল্লা নামক স্থানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ধূপপাতিল গ্রামের এই অ্যামবুশে অংশ নেন নায়েক আবদুল মান্নানসহ ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসে হবিগঞ্জ মহকুমার জুড়ি চা বাগানের যুদ্ধ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন নায়েক আবদুল মান্নান। জুড়ি চা বাগান ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। আবদুল মোমিত আসুকের নেতৃত্বে নায়েক আবদুল মান্নানসহ মুক্তিবাহিনীর একটি দল ২০ আগস্ট ভারতের রাখনা থেকে রওনা দিয়ে ভোরের দিকে পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে পৌঁছায়। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙ্কার থেকে পালাতে শুরু করে। এ সময় ক্যাম্পে থাকা ২০ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।  

২৭ আগস্ট হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর তীরে রানীগাঁও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। এই অপারেশনে অংশ নেন নায়েক আবদুল মান্নান। এম এ জহিরের নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রাত সাড়ে ১১টার দিকে খোয়াই নদীর তীরে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে রানীগাঁও রাজাকার ক্যাম্প ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করে। এ সময় ক্যাম্পে থাকা রাজাকাররা প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে পালিয়ে যায়।  

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম সফল একটি অ্যামবুশ ছিল কালেঙ্গা জঙ্গলের অ্যামবুশ। এই অ্যামবুশে ৬১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। কালেঙ্গা জঙ্গল ছিল ভারতীয় সীমান্তের কাছে। সিলেটের দিকে এস ফোর্স যেসব সেনা পাঠাত, তা কালেঙ্গা জঙ্গলের ভিতর দিয়েই পাঠানো হতো। পাকিস্তানি বাহিনী এই খবর জানার পর কালেঙ্গা জঙ্গলে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়, যেন মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত না করতে পারে।

এরপর কালেঙ্গা রেস্ট হাউজের পাশে কয়েকটি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখে নায়েক আবদুল মান্নানসহ মুক্তিবাহিনীর একটি দল। ফলাফল দেখার জন্য চরও নিযুক্ত করে দলটি। ২০-২১ সেপ্টেম্বরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কালেঙ্গা জঙ্গলে যায়। রেস্ট হাউসের দিকে যাওয়ার সময় তাদের পায়ের চাপে ২টি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সময় তাদের একজন নিহত এবং ৩ জন আহত হয়।

২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অ্যামবুশ করার জন্য সিন্দুরখান-কালেঙ্গা রাস্তায় ফাঁদ পেতে পরিখায় অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছিল মুক্তিবাহিনী। এদিন পাকিস্তানি সেনারা সেখানে ঘাঁটি তৈরি করতে আসে। তাদের সামনে ছিল ২০-২৫ জন রাজাকারের একটি দল। তারা অ্যামবুশের আওতায় এলেও মুক্তিবাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়নি। তারা অপেক্ষা করছিল, কখন পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশের আওতায় আসবে। কিছুক্ষণ পর বেশিরভাগ পাকিস্তানি সেনা অ্যামবুশের আওতার মধ্যে ঢুকে গেলে মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে।

এ সময় আওতায় থাকা প্রায় সব পাকিস্তানি সেনাই নিহত হয়। পেছনে থাকা পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগানের গুলি নায়েক আবদুল মান্নানের বুকে ও মাথায় এসে লাগে। শহীদ হন তিনি।

নায়েক আবদুল মান্নানের জন্ম ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পশ্চিম ডেকরা গ্রামে। ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ১০ম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৩

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

6h ago