খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তম
((মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আজকের পর্বে রইল শহীদ লেফটেন্যান্ট এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তমের বীরত্বগাঁথা।)
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এস এম ইমদাদুল হক ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির অধিনায়ক। সিলেট অঞ্চলে বহু যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ এবং বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ২৫।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমির অফিসার ক্যাডেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন এস এম ইমদাদুল হক। ২৩ মে তারা ১২ জন বাঙালি অফিসার একসঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন এবং বাংলাদেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কলকাতায় আসার পরে এস এম ইমদাদুল হককে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের 'সি' কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এস এম ইমদাদুল হক প্রথম যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টর এলাকায়। তার প্রথম বড় যুদ্ধ ছিল নকশী বিওপির যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে নকশী বিওপির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট এস এম ইমদাদুল হক। এই যুদ্ধে কাট অফ পার্টির দায়িত্বে ছিল তার ডেল্টা কোম্পানি।
এছাড়া বেশ কয়েকটি অ্যামবুশ ও খণ্ডযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এস এম ইমদাদুল হক। জেড ফোর্সের অধীনে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল তাদের সর্বপ্রথম আক্রমণ চালায় মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণাগুল চা বাগানে। চা বাগানটি সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় সীমান্তে নিয়মিত হামলা চালাতো। দক্ষিণাগুল চা বাগানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অবস্থান।
দক্ষিণাগুল চা বাগান অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন এস এম ইমদাদুল হক। দক্ষিণাগুল চা বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম কারণ ছিল ১০৫ আর্টিলারির সাফল্যজনক ব্যবহার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী মৌলভীবাজারের জুড়ীর ফুলতলা-সাগরনাল চা-বাগানে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। ঘাঁটি স্থাপনের পর বেশিরভাগ চা শ্রমিক ও বাগানের কর্মচারীরা পালিয়ে গিয়েছিল। যারা বাকি ছিল এসব চা বাগানের কুলি ও চা শ্রমিকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতো পাকিস্তানি বাহিনী। একই সঙ্গে চা বাগানজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল পাকিস্তানিরা। এই চা বাগান থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অপারেশনে যেত।
জেড ফোর্স সিলেটে আসার পরে চা বাগানগুলো থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সমূলে উচ্ছেদের অন্যতম অপারেশন ছিল এই সাগরনাল চা বাগানের অপারেশন।
অপারেশনের আগে সকালে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ভারতের মাটিতে। এদিন দুপুরের দিকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সবগুলো চা-বাগানে অতর্কিতে আক্রমণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। সাগরনাল থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে ছিল ফুলতোলা চা বাগানও। ফুলতলার পরই ছিল ভারতীয় সীমান্ত এলাকা।
১৫ অক্টোবর রাত ৪টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে চা বাগানে ঢুকে এক টানা আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে পিছু হটলেও এক পর্যায়ে ঘুরে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি মেশিনগান পোস্টের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল এস এম ইমদাদুল হক হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করে দেন। প্রায় ৭ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তাই বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ জন সেনা নিহত হয়। আহত হয় অনেক।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ধামাই চা বাগানের যুদ্ধ এক ঐতিহাসিক স্থান দখল করে আছে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে মৌলভীবাজারের জুড়ীর ধামাই চা বাগান ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার মেজর এ জে এম আমিনুল হক ধামাই চা বাগান থেকে পাকিস্তানিদের হটিয়ে সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ ধামাই পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করতে পারলে এই অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতে সুবিধা হবে। আর পাশেই ভারতীয় সীমান্ত থাকায় পরবর্তীতে ভারতীয় সহায়তা পেতেও সহায়ক হবে। আর তাই ধামাই চা বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন এস এম ইমদাদুল হকের ওপরে।
৭ নভেম্বর ধামাই চা বাগানে রেইড করার সিদ্ধান্ত নেন এস এম ইমদাদুল হকের নেতৃত্বে ১০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল। এই দলটি ছিল জনযোদ্ধা এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের মিশ্রিত একটি দল। ৭ নভেম্বর রাতে ইমদাদুল হকের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত অতিক্রম করে ধামাই চা-বাগান থেকে দূরে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। ঠিক হয়েছিল ভোরের দিকে আক্রমণ করা হবে। এর আগে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দেখার জন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে রেকিতে বের হন এস এম ইমদাদুল হক। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসময় এস এম ইমদাদুল হকের নেতৃত্বে তার বাহিনীও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়। পেছনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়। এসময় এস এম ইমদাদুল হক আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন।
পাকিস্তানি বাহিনীও এসময় তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে। তখন দলনায়ক এস এম ইমদাদুল হক পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে ঢুকে পড়েন পাকিস্তানি ঘাঁটির কাছাকাছি।
এসময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে ইমদাদুল হক ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। পাশেই ছিলেন এস এম ইমদাদুল হকের সহযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক তারু মিয়া। তারু মিয়া বলে উঠেন, 'স্যার, আর এগুবেন না, গুলি লাগবে।' ইমদাদুল হক জবাবে বলেন, 'তারু, আমরা তো আমাদের জন্য যুদ্ধ করছি না। আমরা যুদ্ধ করছি আমাদের সন্তানদের জন্য।'
ইমদাদুল হকের কথা শেষ হতেই এক ঝাঁক গুলি লাগে এস এম ইমদাদুল হকের বুকের বাঁ পাশে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদ হন এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তম। মুক্তিযোদ্ধারা তার লাশ উদ্ধার করে দাফন করেছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের চল্লিশধন কদমতলায়।
শহীদ এস এম ইমদাদুল হকের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ জানুয়ারি যশোরের পাড়নাকান্দা গ্রামে। ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পরে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন এস এম ইমদাদুল হক। ১৯৬৫ সালে কোহাট বেসে এয়ারম্যান পদে কর্মরত থাকাকালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর করপোরাল পদে পদোন্নতি লাভ করেন এস এম ইমদাদুল হক। ১৯৬৮ সালে আইএ পাস করে ১৯৭০ সালের ১৪ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তম।
সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments