মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম

মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের অষ্টম পর্বে রইল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ছিলেন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৮।  

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে 'ব্রিগেড মেজর' হিসেবে মেজর এম এ মঞ্জুর কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের শিয়ালকোটের চতুর্দশ প্যারা ব্রিগেডে। ২৬ জুলাই রাত ৮টার দিকে বেশ কয়েক দফা চেষ্টার পর মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও মেজর এম এ মঞ্জুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ২৭ জুলাই এই দলটি দিল্লি পৌঁছে। ৭ আগস্ট কলকাতায় পৌঁছান মেজর মঞ্জুরসহ বাকিরা। মেজর মঞ্জুরকে পরে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা। পরে যদিও বরিশাল ও পটুয়াখালীকে সেক্টর থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই সেক্টরে কুষ্টিয়ার উত্তর থেকে খুলনার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ মাইল সীমান্ত ছিল। ৮ নম্বর সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিল ২ হাজার এবং গণবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার। এই সেক্টরের সদরদপ্তর বেনাপোলে থাকলেও কার্যত সদরদপ্তরের একটা বিরাট অংশ ছিল ভারতের কল্যাণী শহরে।

সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরে মেজর এম এ মঞ্জুর দেখলেন, গণবাহিনী নিয়মিত বাহিনীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদেরকে যদি তার অধীনে নিয়ে আসা না হয়, তবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ সময় তিনি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সেক্টরকে পুনর্গঠিত করা এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, গণবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সেক্টর কমান্ডারের আওতায় নিয়ে আসা, সেক্টর অঞ্চলকে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ বিশেষ এলাকায় ভাগ করা এবং প্রতিটি স্থানের জন্য কমান্ডার নিযুক্ত করা, গণবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা আনয়নে রাজনৈতিক উপদেষ্টা পাঠানো, রাজাকারদের বিষয়ে সেক্টর কমান্ডারদের বিশেষ নির্দেশ ইত্যাদি।

পাশাপাশি, এম এ মঞ্জুর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আসার পর গণবাহিনীতে ভর্তি বাড়িয়ে দেন। ট্রেনিং কমিয়ে ৩ সপ্তাহ করেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠনের কাজ হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে মেজর আবুল মঞ্জুর গণবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীকে একটি চেইনে নিয়ে আসেন। এতে করে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক সাফল্যের দেখা পায়।

মেজর মঞ্জুর অন্য আরেকটি দিকেও নজর দেন। তিনি ভেবে দেখলেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে শুধু তাড়ালেই হবে না। পুরো পাকিস্তান প্রশাসন যেন ভেঙ্গে পড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে। তিনি তাই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক কোম্পানিতে একত্রিত করে থানাগুলো দখল করার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মংলা ও চালনা বন্দর অকেজো করার নির্দেশ দেন।

আগস্ট মাস থেকে মেজর মঞ্জুরের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা, জীবননগর, হাঁসদহ, খালিশপুর, কোটচাঁদপুর, কাপাশডাঙ্গা, কালীগঞ্জসহ কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এত বেশি মাইন পাতেন যে পাকিস্তানি বাহিনীকে ট্রেনের সামনে বালির গাড়ি লাগিয়ে চলাচল করতে হতো। মুক্তিযোদ্ধারা যেন মাইন লাগাতে না পারেন, সেজন্য গ্রামবাসীকে লণ্ঠন নিয়ে রাতে পাহারা দিতে বাধ্য করত পাকিস্তানি বাহিনী। তখন মেজর মঞ্জুর সেই নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর বাইরে মাইন লাগানোর নির্দেশ দেন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আসেন, তাদের বেইস গঠন করার জন্য পাঠান তিনি। ক্যাপ্টেন ওহাবের নেতৃত্বে মাগুরায় এবং আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে বেইস ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাপ্টেন ওহাবের বাহিনীতে ৭০ জন নিয়মিত বাহিনীর সেনা ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন ওহাব যখন তার সেনাদের নিয়ে মাগুরায় যান তখন গুজব রটে যায়, একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ৭-৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা মাগুরাতে অপারেশন করতে যাচ্ছেন। সেই সংবাদে পাকিস্তানি বাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলে। এই গুজব রটানো হয়েছিল মেজর মঞ্জুরের নির্দেশে।

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধগুলোর একটি খুলনার শিরোমণির যুদ্ধ বা ব্যাটেল অফ শিরোমণি। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ছিলেন মেজর এম এ মঞ্জুর এবং ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল।

৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার হায়াত খানের এমন সিদ্ধান্ত মেজর মঞ্জুরের কাছে যথেষ্ট সন্দেহজনক মনে হলো। কারণ যশোর ক্যান্টনমেন্ট প্রচণ্ড সুরক্ষিত ও শক্তিশালী। মেজর মঞ্জুর ভাবলেন, হয় মার্কিন সপ্তম নৌ বহর আগমনের খবরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে হায়াত খান এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, না হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টকে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে পারছেন  না।

এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী বিশাল ট্যাংক বহর, পদাতিক সেনা ও রাজাকারদের নিয়ে খুলনার শিরোমণি এলাকায় জড়ো হয়। এরপর তারা খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলে। সবচেয়ে বড় ক্যাম্প হলো জনশূন্য শিরোমণি এলাকায়।

হায়াত খান ট্যাংক ও গোলন্দাজ ব্রিগেড নিয়ে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এ ছাড়া, আটরা থেকে শিরোমণি এলাকার যশোর রোডে মাইন পুঁতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করেও পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো সাড়া না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পাতা ফাঁদে পা দেন ফুলতলার চৌদ্দ মাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির নেতৃত্বাধীন একটি বড় কনভয়। ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা হয় তারা। মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমণি এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রের নিশানার মধ্যে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালাতে শুরু করে। ফলে মিত্রবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।

পরে পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের ঘাঁটি আরও সুরক্ষিত করতে থাকে। ফলে মিত্রবাহিনী নিজেদের ঢেলে সাজানো শুরু করে। তখন মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল দলবীর সিং মেজর মঞ্জুরের হাতে যুদ্ধের নেতৃত্ব ছেড়ে দেন। এ সময় মেজর মঞ্জুর উপ-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ কৌশল ও অপারেশনের নকশা তৈরি করেন। মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে প্রথমে চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুল থেকে মেজর জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়।

এরপর মিত্রবাহিনীর অপর একটি ইউনিট শিরোমণির ঠিক পূর্বপাশে অবস্থান নিয়ে পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশে গোলা ছুড়তে থাকে। মেজর মঞ্জুর তার বাহিনী নিয়ে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ২ দিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে শিরোমণিতে সীমিত জায়গার ভেতর ঘিরে ফেলেন।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা না মেনে তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং ৪ হাজার সেনার বিরুদ্ধে ওই রাত থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধ। মেজর মঞ্জুর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গি পরে মাথায় গামছা বেঁধে শ্রমিকের বেশে ২ হাতে ২টি স্টেনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি ট্যাংক বহরের ভেতরে। প্রতিটি ট্যাংকের ভেতরে খুঁজে খুঁজে গানম্যানদের হত্যা  করেন। সারারাতব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হলে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ১৭ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় খুলনা।

মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের জন্ম ১৯৪০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার গোপীনাথপুর গ্রামে। তবে তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল নোয়াখালীর চাটখিল থানার কামালপুর গ্রামে। এম এ মঞ্জুরের পড়াশোনা শুরু হয় কলকাতায়। পরে ঢাকায় আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি পাঞ্জাবের সারগোদা পাবলিক স্কুল থেকে সিনিয়র ক্যাম্বিজ এবং ১৯৫৬ সালে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কাকুল সামরিক একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক একাডেমি থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিএসপি অফিসারও হয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৮ সালে কানাডার স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন্ড পদে যোগদান করেন। দেশ স্বাধীনের পর এম এ মঞ্জুর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি যশোরে ৫৫ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৭৩ সালে তাকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ পদে নিয়োগ পান এম এ মঞ্জুর। চট্টগ্রামে সেনাবহিনীর ২৪তম ডিভিশনের জিওসি হিসাবে নিযুক্ত হন ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৮১ সালের ২৯ মে পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন মেজর মঞ্জুর। ১৯৮১ সালের ২ জুন নিহত হন এম এ মঞ্জুর, বীর উত্তম।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড

বাংলাপিডিয়া

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ৮

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

                      

Comments

The Daily Star  | English

Sweeping changes in constitution

Expanding the fundamental rights to include food, clothing, shelter, education, internet and vote, the Constitution Reform Commission proposes to replace nationalism, socialism and secularism with equality, human dignity, social justice and pluralism as fundamental principles of state policy.

2h ago